চামড়া নিয়ে চালবাজির নেপথ্যে কারা?

হাসান হামিদ

কয়েক বছর ধরে কুরবানি ঈদে বাংলাদেশে লাখ লাখ পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়। আবার এদেশেই ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ট্যানারির মালিকেরা বিদেশ থেকে আমদানি করেছেন প্রায় ৯৪৫ কোটি টাকার বিদেশি চামড়া। কী? আঁতকে উঠলেন? চামড়া নিয়ে এই ভানুমতির খেল একেবারে নতুন নয়। তবে এ বছর কোরবানির চামড়া নিয়ে যা ঘটল, তা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। চামড়া নিয়ে এইসব চালবাজির গল্প বলার আগে একটু ফেলে আসা দিনে যাই।

ছোটবেলায় স্কুলে সবাই পড়েছি পাটকে কেন বাংলাদেশের সোনালী আঁশ বলে! মনে আছে? একসময় পাটশিল্প ছিল এদেশের অর্থনীতির অন্যতম বৃহত্তম খাত। কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে পাটশিল্প আজ আর সেই জায়গায় নেই। অথচ ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমরা মুখস্থ করেছি, পূর্ববাংলার পাট রপ্তানির টাকা কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আর অন্যদিকে আমরাই স্বাধীন বাংলাদেশে পাটচাষিদের না খাইয়ে মারছি, বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজীকে হত্যা করেছি। সবমিলিয়ে পাট থেকে রপ্তানি আয় ক্রমাগত কমছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ১০২ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলার, ২০১৮-১৯-এ অর্জন মাত্র ৮১ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। এক বছরে কমেছে ২০ কোটি ৯৩ লাখ মার্কিন ডলার। (সূত্র: রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো) চামড়া শিল্পে যা চলছে, এর অবস্থাও এমন হবে সে আশংখা অমূলক নয়।

খবরে দেখলাম, রাজশাহীতে দাম না পেয়ে কোরবানির পশুর চামড়া পদ্মা নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঈদের পরদিন দুপুরে পদ্মায় ১ হাজার ৫০০ পিস চামড়া ফেলে দেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামে বিক্রি না হওয়া ১৫ হাজারেরও বেশি কোরবানির পশুর চামড়া ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে এসব চামড়া নগরীতে বিক্রি করতে এনে দাম না পেয়ে ফেলে চলে যান মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, দেশের বেশিরভাগ জায়গায় এই ঘটনা ঘটেছে। তাহলে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় যে হিসাব করে রাখল, এর কী হবে! তাদের হিসেবে এ বছর ১ কোটি ১৩ লাখ পশু জবাই হওয়ার কথা এবং সে হিসেবে এই পরিমাণ চামড়াও সংগ্রহের কথা। অপরদিকে ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের হিসাবে আমাদের দেশে গরু কোরবানি হয়েছে ৪৬ লাখ। তাই তাদের হিসাব মোতাবেক ৪৬ লাখ চামড়া সংগ্রহের কথা। কিন্তু তা আর হল কই!

মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববাংলায় চামড়াশিল্পের অপার সম্ভাবনার কথা আজ থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় আগে একজন ইউরোপীয় ইহুদি ভেবেছিলেন। তিনি স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। একজন রসায়নবিজ্ঞানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগকে তিনি বিশ্বমানের করতে চেয়েছিলেন, যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েও একদিন নোবেল পুরস্কার আসে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল তরুণ শিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষসহ আরও কয়েকজনকে তিনি বেশি বেতন দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন রসায়ন বিভাগকে সমৃদ্ধ করতে। ১৯২৪ সালে চামড়া রসায়ন নিয়ে গবেষণা করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ট্যানিং অ্যান্ড লেদার কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট’ খোলার সুপারিশ করে সরকারের কাছে অর্থ বরাদ্দ চান হার্টগ। পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে চামড়াশিল্প বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে, সে কথা সরকারকে লিখে জানান। ১৯২৫ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের অভিবাসনে হার্টগ বলেছিলেন, ‘চামড়া বিভাগের অধীনে একটি লেদার প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা এবং কিছু অর্থ আমার আছে।’ হার্টগ-এর পরবর্তী উপাচার্য জি এইচ ল্যাংলিও চামড়া প্রকল্প এগিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। তারা দুজনই চেয়েছিলেন সমগ্র বাংলায় ঢাকা হবে চামড়াশিল্পের প্রধান কেন্দ্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হয়েও উঠেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও চামড়া ছিল তৈরি পোশাক শিল্পের পর প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও গত অর্থবছরে পোশাকশিল্পের পরে সর্বোচ্চ ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে চামড়া শিল্প রপ্তানি আয়ে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। চামড়া খাত থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

ঈদুল আযহার পশু কুরবানির পরেই বিকাল নাগাদ সাধারণত পশুর চামড়া চলে যায় চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে। এবারে হয়েছে এর ব্যতিক্রম। দেশের নানা স্থানে চামড়া বিক্রির ন্যায্য মূল্য না পেয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পশুর চামড়া মাটিতে পুতে ফেলে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সেই ছবি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছে সরকার নির্ধারিত যে দাম বেধে দিয়েছিল, তারচেয়ে অনেক কম দামে কিনতে যেয়ে নি:স্ব হতে হয়েছে তাদের। কিন্তু এমন পরিস্থিতি কেন হল, এর নেপথ্যে কারা তা আসলে ওপেন সিক্রেটের মত ব্যাপার!

পত্রিকায় পড়েছি, আড়তদারদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা ট্যানারি মালিকদের কাছে ১৫৩ কোটি টাকা পাবেন। কোরবানিকে সামনে রেখে সরকার ট্যানারিগুলোকে চামড়া কেনার জন্য ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার নির্দেশনা দিলেও ব্যাংকগুলো এ টাকা ছাড়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও চামড়া শিল্পে ধস নামতে পারে এমন আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের চামড়ার এক বড় অংশ রপ্তানি হয় চীনে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীনে চামড়া কতটা রপ্তানি করা যাবে তা নিয়ে এবার সংশয় রয়েছে। আড়তদারদের দাবি, নগদ টাকা না থাকায় তারা এ বছর বেশি দামে চামড়া কিনতে পারেননি। আর ট্যানারি মালিকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় চামড়ার দাম কমে গেছে। এছাড়া গত বছর যে পরিমাণ চামড়া কেনা হয়েছে, তার অর্ধেকই রয়ে গেছে। যেহেতু চাহিদা কম, তাই চামড়ার দামও কম, যা গত ৩১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এদিকে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উদ্ভূত সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে নানা ধরনের দায়িত্বহীনতা হিসেবেই বলছেন। বোঝা যাচ্ছে, চামড়ার এমন দরপতনের সংশ্লিষ্টরা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা দোষারোপ করছেন পাইকারি ক্রেতাদের, পাইকারি ক্রেতারা বলছেন আড়তদাররা কম দামে চামড়া ক্রয় করছেন। আড়তদার বলছেন ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশন থেকে আমাদের বকেয়া পরিশোধ করেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের আর্থিক ক্ষমতা বাড়ায় পশু কোরবানির সংখ্যা যেমন বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে চামড়া সংগ্রহ ব্যবস্থা পাল্টায়নি, আর মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। চামড়ার যে দাম কমেছে, মূল্যস্ফীতি বিবেচনা করলে সেই পতন আসলে আরো বেশি হবে। চামড়া মালিকদের কাছে আগের স্টক থাকা, বৈশ্বিক দর পতন, রপ্তানির শ্লথগতি এরকম অনেক কারণ রয়েছে। তারা বলছেন, সেজন্য আধা-প্রক্রিয়াজাত চামড়ার যে বাজারগুলো বিশ্বে রয়েছে, সেদিকে আমাদের নজর দেয়া দরকার। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

চামড়া শিল্প  দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ বাজার ও রপ্তানির জন্য চামড়া এবং চামড়াজাত সামগ্রী উৎপাদন করে আসছে। কাঁচা চামড়া এবং সেমিপাকা চামড়া বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রপ্তানি সামগ্রী। সব সময়ই বিশ্ব বাজারে এ দেশের ছাগলের চামড়ার চাহিদা রয়েছে। গত দু দশকে এ খাতে উল্লেখযোগ্য আধুনিকায়নও ঘটেছে। এর ফলে বিশ্বে প্রথম শ্রেণির চামড়া ও চামড়ার তৈরি সামগ্রী প্রস্ত্ততকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করেছে। বিশ শতকের সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে পরবর্তী সরকারগুলি চামড়া শিল্পকে রপ্তানি মূল্যের ওপর ভর্তুকি প্রদান করে আসছে। শতকরা ৯৫ ভাগ কাঁচা চামড়া এবং চর্মজাত দ্রব্যাদি, প্রধানত আধা পাকা ও পাকা চামড়া, চামড়ার তৈরি  পোশাক এবং জুতা হিসেবে বিদেশে বাজারজাত করা হয়। অধিকাংশ চামড়া এবং চামড়ার সামগ্রী রপ্তানি করা হয় জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, রাশিয়া, ব্রাজিল, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর এবং তাইওয়ানে। এসব রপ্তানির মূল্য সংযোজনের শতকরা ৮৫ ভাগ স্থানীয় এবং ১৫ ভাগ বিদেশি। ঢাকা মহানগরীর প্রধানত হাজারীবাগ এলাকায় বর্তমানে প্রায় ১০০ চামড়ার কারখানা চালু রয়েছে। কিন্তু গত বছর এবং এবার কুরবানি ঈদে চামড়া নিয়ে যা হয়েছে, তাতে এ শিল্পের সফলতা ও সম্ভাবনার ধারাবাহিকতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

আরেকটি বিষয়ও কুরবানির পশুর চামড়ার সাথে সংশ্লিষ্ট। আমরা জানি, এ দেশের অনেক মাদ্রাসা এবং এতিমখানা কোরবানির পশুর চামড়ার ওপর নির্ভর করে। অনেকেই তাদের জবাই করা পশুর চামড়া বিনামূল্যে মাদ্রাসা এবং এতিমখানায় দান করে। আর সেইসব চামড়া বিক্রির মাধ্যমে মাদ্রাসাগুলো অর্থ উপার্জন করে। এবার চামড়ার দামে নিম্নগামী হওয়ায় মাদ্রাসাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন সরকার রপ্তানির অনুমোদন দিলেও মাদ্রাসাগুলোর কোন লাভ হবে না। আবার অনেক মানুষ কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করে গরিব এবং অসহায়দের দিয়ে দেয়। এর মানে যত টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর পুরোটাই গরিব এবং অসহায় লোকদের পকেট থেকে গেছে। তবে চামড়া নিয়ে সৃষ্ট সংকট কেটে যাবে বলে আমরা আশাবাদী। আগামী দিনে এ ধরনের বিপর্যয় এড়িয়ে চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকেও। চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটকারীদের তুঘলকি কাণ্ড কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলেই চামড়া শিল্পে সুদিন ফিরবে। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায়।

প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ১৩ আগস্ট, ২০২০

চামড়া নিয়ে চালবাজির নেপথ্যে কারা?
Scroll to top