চাকরি এখন সোনার হরিণ নয়, আষাঢ়ে গল্প !

হাসান হামিদ

বেশ কয়েক দিনের লম্বা অবকাশ যাপনে ছিলাম । অফিসে এসে সকালে চা খেতে খেতে একটি প্রতিবেদনে চোখ আটকে গেলো; শঙ্কিত হলাম। চলমান  অর্থনৈতিক মন্দাসহ বিভিন্ন সমস্যায় জাতিসংঘের  শ্রম বিষয়ক সংস্থা  ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’ চলতি বছর  বিশ্বে বেকারত্বের হার আরও  বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে । সংস্থাটি  ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড স্যোশাল আউটলুক- ট্রেন্ডস’  শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য  জানিয়েছে  । প্রতিবেদনে জানানো হয়,  আগামী দুই বছর উদীয়মান ও উন্নয়নশীল  দেশগুলোয়  বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়বে। প্রতিবেদনে  আরও বলা হয়,  চলতি বছর বিশ্বে মোট বেকার লোকের সংখ্যা ১৯ কোটি ৯০ লাখে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। আর  ২০১৯ সাল  নাগাদ তা ২১ কোটি ছাড়াবে।  আইএলও’র গবেষণা বিভাগের পরিচালক রেয়মন্ড বলেছেন,  অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে উদ্বায়ী মূলধনের প্রবাহ আর্থিক বাজারকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নীতি-নির্ধারকদের এ বিষয়টায় আরও মনযোগী হওয়া জরুরি।

আমার আশেপাশের অনেক ভালো ফলাফল করা ছেলেদের আজকাল বেকার দেখি । প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায়  অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। বেকার বলতে শ্রমশক্তির  সেই অংশকে বুঝানো হয়,  যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সন্ধান করা  সত্ত্বেও কোন কাজ পান না। বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে পনেরো বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা  হয়েছে যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য প্রস্ত্তত থাকা  সত্ত্বেও কোন কাজ পায়নি ।  কাজের বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই  চলেছে। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী,  দেশে বর্তমানে  শ্রমশক্তির পরিমাণ পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ মানুষের কাজ আছে। এর অর্থ মাত্র ২৬ লাখ মানুষ বেকার। তবে জরিপেই বলা আছে, পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ। এ ছাড়া আছে আরও এক কোটি ছয় লাখ দিনমজুর,  যাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা  নেই। বিশ্বব্যাংক মনে করে,  সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে  বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ  মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছেন। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে । সংস্থাটির মতে,  বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের হার ২ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হবে। আর তাহলেই ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হওয়া সম্ভব।  আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) তথ্যমতে,  বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি এবং বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। এ ছাড়া জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির তথ্যমতে,  বাংলাদেশে বেকার যুবকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে,  চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক হয়েও বাংলাদেশে অনেকে জনপ্রশাসনের চাকরিতে গেছেন। এর কারণ  হিসেবে চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে তাদের জ্ঞান যথাযথ নয়। আবার রাজনীতি বিজ্ঞান পড়ার শেষে একটি আইটি কোর্সে ভর্তি হয়ে আইটি খাতে কাজ করছেন এমন সংখ্যাও কম নয়। চিকিৎসক ও প্রকৌশলী হয়েও সরকারের প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্যাডারে কত কর্মকর্তা রয়েছেন, এ বিষয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্রমতে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। ইকোনমিস্ট বলছে,  এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের দ্বিমত রয়েছে। তাঁরা মনে করেন,  শিক্ষা পরিকল্পনায় গলদের কারণে এটা হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা নিজের আগ্রহ ও পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারেন না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যে বিষয়ে সুযোগ পান, সেটা পড়তে বাধ্য হন। আর চাকরির ক্ষেত্রে যে সুযোগ  আসে সেখানেই যোগ দিতে চান। এর মধ্যে পড়াশোনার পাশাপাশি অনেকেই নিজেদের কারিগরি যোগ্যতা ও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশির ভাগই এ কাজটি করেন না। চাকরির বাজারে তারাই এগিয়ে যান, যারা নিজেদের বিশেষায়িত যোগ্যতা  বাড়িয়ে নেন।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় পরিকল্পনার অভাব  রয়েছে বলে মনে করে ইকোনমিস্ট। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখানকার নীতিনির্ধারকেরা জানেন না,  শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোন খাতে কত শিক্ষার্থী প্রয়োজন। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার তুলনামূলকভাবে স্বল্পশিক্ষিতদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। বাংলাদেশ  সরকারের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুসারে এখানকার প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো হলো তথ্যপ্রযুক্তি,  কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ,  চামড়াজাত পণ্য,  জাহাজনির্মাণ, পোশাক খাত,  পর্যটন সেবা,  কারিগরি নির্মাণ খাত ইত্যাদি । কিন্তু এসব খাতের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত যথাযথ কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর অভাব রয়েছে।  এটার জন্য কী ধরনের দক্ষতার কর্মী চাহিদা রয়েছে, সেটার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের  শিক্ষাক্রম তৈরি করা জরুরি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃত করে ইকোনমিস্ট বলেছে,  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন কাঠামো, তদারকি, মাননিয়ন্ত্রণ ঠিকমতো করতে হবে। উচ্চশিক্ষা পাঠ্যক্রম তৈরিতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যক্রম সময়োপযোগী করতে হবে। এ জন্য আইনপ্রণেতা,  নিয়োগকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয় খুব দরকার।

বাংলাদেশে বেকারত্ব  হলো  কাজের অভাবে অনিচ্ছাকৃত কর্মহীনতা। আমাদের দেশের যারা বেকার তারা কাজ করতে চাইছেন না, তা কিন্তু নয়; মূলত তারা কাজ পাচ্ছেন না । আবার নিন্মমধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত ঘরের একটি ছেলে পড়াশোনা শেষ করে উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস, উৎসাহ বা মূলধন কোনোটিই পরিবার থেকে পায় না । তবে আশার কথা হল, পরিসংখ্যান অনুযায়ী  ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই  লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। গত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এর বাইরে বাণিজ্য বড় হয়েছে ।  অর্থনীতির এসব বহুমুখিতার  কারণে বেকারের সংখ্যা বাড়ার কথা নয়। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পিরিয়ে এসে কাজহীন একটি স্বপ্নবান তরুনের নির্ঘুম রাত আর যেনো কাটাতে না হয় । শিক্ষাব্যবস্থার মানউন্নয়ন, প্রশিক্ষণ প্রদান, পরিকল্পনা গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন ও উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস এবং উৎসাহ পেয়ে আমরা বড় হতে চাই । আমরা নির্মাণ করতে চাই উন্নত ও সুখি এক বাংলাদেশ ।

প্রকাশিত পত্রিকা-

দৈনিক দেশকাল ০৩/০২/২০১৭

দৈনিক সিলেটের সংবাদ ০৩/০২/২০১৭

প্রথম সকাল ০৩/০২/২০১৭

চাকরি এখন সোনার হরিণ নয়, আষাঢ়ে গল্প !
Scroll to top