চাকরিপ্রত্যাশীদের করোনাকাল : সংকট ও দুর্ভাবনা

হাসান হামিদ

মহামারি নিয়ে মিসরের কবি নাজিক আল মালাইকার একটা কবিতা আছে। কবিতাটা অনেকটা এরকম,

‘‘কান পেতে শুনো, তাকিয়ে দ্যাখো,

মৃদুপায়ে হেঁটে যাচ্ছে ভোরের মিছিল,

দশ, বিশ, পঞ্চাশ; বিষাদের বিষে নীল

জনপদ হয়েছে ছারখার, লাশগুলো পড়ে আছে বেশুমার।

এদের তিরোধানে ঝরছে না অশ্রু কোনো শোকগাঁথায়

হচ্ছে না কেউ অন্যমনস্ক মুহূর্তের মৌণতায়,

মৃত্যুর অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয় মানবতা

মহামারি যেন তৈরি করে সামাজিক শাস্তির নিত্য নতুন প্রথা,

এমন কি গোরখাদকেরা মহামারির কাছে করেছে আত্মসমর্পণ

করুণভাবে মোয়াজ্জিনেরও হয়েছে মরণ;

কে এবার দেবে জানাজার দাওয়াত’’

মহামারি আসলেই সামাজিক নিত্য নতুন প্রথা তৈরি করে। বদলে দেয় সবকিছু। লাশের মিছিলে ইমাম যুক্ত হলে, জানাজা পড়ানোর জন্য সাধারণ কেউ ইমাম হন। সব এভাবেই বদলে যায়। ঘরে বসে আছি আড়াই মাস। এই কদিনে অনেক অভ্যাস বদলেছে। এক তারিখ থেকে অফিস-আদালত-ব্যবসা সব সীমিত আকারে চালু হবে। আমরা যারা চাকরি বা ব্যবসায় নিয়োজিত, তারা হয়তো ধীরে ধীরে ব্যস্ত ও কর্মময় জীবনে দ্রুতই ফিরে যাবো আগের মতো। হয়তো ব্যবধান থাকবে সতর্কতায়। চাইলেই আর অফিস শেষে টিএসসি কিংবা শিল্পকলার মাঠে পা ছড়িয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে আড্ডা দিতে যাবো না। কিন্তু জীবন মানিয়ে যাবে। আবার আগের মতোও হবে। কিন্তু যারা সদ্য স্নাতক, কিংবা হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন কাজের সুযোগ তাদের জন্য ঠিক এই সময়টা কি আরও একটু কঠিন হয়ে গেল? চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা সব সময়ই ছিল। করোনার কারণে সেটি আরও বাড়লো। কারণ সব ধরনের সমীক্ষা যা বলছে, তাতে মনে হচ্ছে সুরঙ্গ পথের শেষে যে আলো, সেটি আরেকটু দূরে- পিছিয়ে গেছে।

গতকাল ২৮ মে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের দেয়া বক্তব্য অনলাইনে পড়ছিলাম। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বক্তব্যে বলেছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অগ্রগতির পরেও বর্তমানে সারাবিশ্ব করোনাভাইরাসের কারণে অত্যন্ত সঙ্কটের মধ্যে আছে। এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে করোনাভাইরাস মহামারিটি বিশ্বজুড়ে অকল্পনীয় ধ্বংসযজ্ঞ এবং যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। করোনার আঘাতে বিশ্বে  ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ প্রায় আসন্ন। ছয় কোটি মানুষ দারিদ্র্যের নিম্নসীমায় চলে যেতে পারে। বিশ্বের অর্ধেক মানুষ কাজ হারিয়ে ফেলতে পারে। এক দশমিক ছয় বিলিয়ন মানুষ জীবিকা হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে। সারাবিশ্বে আট দশমিক পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। ১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব।

বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও করোনায় চাকরির সুযোগ কমে যাচ্ছে। নিয়োগদাতারা এখন আর নতুন কর্মীর সন্ধান তেমন একটা করছেন না বলেই মনে হয়। করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চাকরি খোঁজার পোর্টালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেখলাম। প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক(এডিপি)। প্রতিবেদনে তারা বলছে, গত এপ্রিল মাসে অনলাইন পোর্টালটিতে আগের বছরের এপ্রিলের তুলনায় ৮৭ শতাংশ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমেছে। এ কাজে বাংলাদেশের বৃহত্তম অনলাইন জব পোর্টাল বিডিজবসের তথ্য উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা জানি, বর্তমানে অনলাইনে পোর্টালের মাধ্যমে চাকরি খোঁজা তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয়। এডিবি বলছে, বাংলাদেশের অনলাইন জবপোর্টালের নেতৃত্ব দেওয়া বিডিজবসে ২০১৯ সালে ৬০ হাজারের বেশি চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। পোর্টালটির ভিজিটর সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ। এডিবির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে গত মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমতে থাকে। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সংখ্যা তেমন একটা কমেনি। ফেব্রুয়ারি মাসে অবশ্য কিছুটা কমেছে। এডিবি তাদের রিপোর্টে বলছে, গত এপ্রিল মাসে আগের বছরের এপ্রিলের তুলনায় ৮৭ শতাংশ কম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এসেছে।

করোনার কারণে কোন খাতে কত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমেছে, সেটাও এডিবি তাদের প্রতিবেদনে দেখিয়েছে। এডিবি বলছে, গত এপ্রিল মাসে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় বস্ত্র খাতে ৯৫ শতাংশ চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া কমেছে। উৎপাদন খাতে এই কমার প্রবণতা ৯২ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, এই শঙ্কায় এসব খাতে নতুন নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা কমেছে। একইভাবে স্বাস্থ্য ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমেছে যথাক্রমে ৮২ ও ৮১ শতাংশ। তবে এনজিও খাতে নতুন লোকের সন্ধান বেশি কমেনি। এডিবি মনে করছে, করোনার কারণে নানা ধরনের সহযোগিতা কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় এনজিও খাতে অন্য খাতের মতো জোরালো প্রভাব পড়েনি। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, চাকরির বাজার করোনার কারণে সংকুচিত হয়ে আসছে।

আসলে শুধু বাংলাদেশে নয়, করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বেই বেকার হু হু করে বাড়ছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে। শুধু এপ্রিল মাসে ২ কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে দেশটিতে। ১৯৩০ সালে বিশ্ব মহামন্দার পর এতটা খারাপ সময় পার করেনি দেশটি। সবমিলিয়ে দেশটিতে বেকার ভাতার আবেদন জানিয়েছে ৩ কোটি ৩৩ লাখের বেশি মানুষ। অথচ মাত্র এক মাস আগেও দেশটির বেকারত্বের হার ছিল মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ; যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

ঠিক একই অবস্থা ইউরোপের দেশগুলোতেও। কঠিন সময়ে মানুষের চাকরি ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩৩০ কোটি কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৮১ শতাংশই ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কারখানা পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ হিসেবে বিশ্বের পাঁচ জন কর্মজীবীর চার জনই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইউরোপের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। লকডাউন ও মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব দেশে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। এসব থেকে বোঝা যায়, সামনে খুব খারাপ একটা সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

করোনাভাইরাসে বিশ্বের কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা বলছে আইএলও। তারা বলেছে, করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও শ্রম সংকটে বিশ্বে প্রায় আড়াই কোটি বেকার বাড়বে। তাদের করা এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা ও কোয়ারেন্টিনের কারণে কর্মী সরবরাহ কমছে। আইএলওর মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেছেন, করোনাভাইরাস এখন আর শুধু বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট নয়। এটি বড় শ্রম এবং অর্থনৈতিক সংকটও। বিশ্ববাসীর ওপর এর বিশাল প্রভাব পড়বে। বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ আবার বলেছেন, ২০২৩ সালের আগে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গতি আসবে না। তার মানে এরই মধ্যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের সবাই কাজের সুযোগও হয়তো পাবেন না। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় থাকলেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর বেকাররা দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে।

আমাদের ভাবতে হবে করোনা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আরো বেড়ে গেল কিনা। যে যতোই অন্য কথা বলুন, ত্রাণ নিয়ে গেলে হুমড়ি খেয়ে মানুষের তা নিতে আসা দেখলেই পরিস্থিতি আন্দাজ করা যায়। আর করোনা পরিস্থিতি এখন দেশের সব খাতেই প্রভাব ফেলছে। তবে অনানুষ্ঠানিক খাতে এর প্রভাব বেশি, এরই মধ্যে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। আমরা দেখছি, বেকার হয়ে পড়েছেন আমাদের দেশের পরিবহনশ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুর, হোটেল-রেস্তোরাঁকর্মী, ছোটো দোকানদার এরা সবাই। আর নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অনেকেই রয়েছেন চাকরি হারানোর ভয়ে। ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি ইতিমধ্যেই বেতন ভাতা না দেয়া বা আংশিক দেয়ার মধ্যে চলছে, সামনে হয়তো কর্মী ছাঁটাই শুরু হবে।

এবার দেখি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কী বলছে। তাদের দেয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের ৫ কোটি ১৭ লাখ শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছে। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ ভাগ। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হওয়ায় এই বিপুল পরিমাণ মানুষ রয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। লকডাউনের ফলে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজ না করলে কোনো উপার্জন থাকে না বলে জীবনযাত্রার মানও তাদের উন্নত নয়। বিবিএসের হিসেবে ২০১৯ সাল শেষে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ২০ শতাংশ। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম এক গবেষণায় বলেছে, যদি পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকে সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আয় ২৫ ভাগ কমে গেলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরো ২০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। তার মানে, করোনার প্রভাবে আমাদের দেশে দরিদ্রতা বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে।

আমাদের দেশে সন্তোষজনক চাকরি না পাওয়া নিয়েই উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা দেখি। আর এখন উচ্চশিক্ষিত বিপুল পরিমাণ বেকার তরুণরা যদি চাকরি খোঁজারই সুযোগ না পায় বা সুযোগ কমে যায়, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আবার যারা এখন পিছিয়ে পড়বেন, তারা পরাজিত হওয়ার তকমা পাবেন সমাজ কিংবা পরিবার থেকে। এটি যেন না হয়। পরিবারের অন্য সদস্যদের সেটি বুঝতে হবে। কারণ এই ‘পরাজিত তকমা’য় এখন শিক্ষিত তরুণের জীবনে কী দুর্যোগ নেমে আসতে পারে তা অনুমান করা সহজ নয়। 

মোটকথা হলো বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বদলে দেবে আগামীর চাকরির বাজারের অনেক স্বাভাবিক চিত্র। বাংলাদেশে এমনিতেই চাকরি পাওয়াকে সোনার হরিণ হাতে পাওয়া বলা হয়। আর এখন করোনার কারণে দেশের বেশিরভাগ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা যেভাবে সংকুচিত হয়েছে, তা কবে নাগাদ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে, তা কেউ বলতে পারবে না। করোনার এই সময়ে এবং এ অবস্থার পরবর্তী সময়ে চাকরি পাওয়ার লড়াই সহজ হবে না বলা যায়। তাই নিজেকে অন্যের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য প্রমাণ করতে এবং নিজের দক্ষতা বাড়াতে পরিশ্রম করতে হবে। নিজেকে আগামীর পৃথিবীর জন্য তৈরি করতে হবে। আমাদের মেধাবীরা তৈরি হোক আগামীর পৃথিবীর জন্য, এই গ্রহকে দেবার এবং এর জন্য করার অনেক কিছু এখনও রয়ে গেছে। সবশেষে কবি হেলাল হাফিজের কয়েক লাইন, 

‘‘নিদারুণ দুঃসময়ে বড়ো বেশি অসহায় একা পড়ে আছি।

তুমুল ফাল্‌গুন যায়, ডাকে না কোকিল কোনো ডালে,

আকস্মিক দু’একটা কুহু কুহু আর্তনাদ

পৃথিবীকে উপহাস করে।

একদিন কোকিলেরো সুসময় ছিলো, আজ তারা

আমার মতোই বেশ দুঃসময়ে আছে

পাখিদের নীলাকাশ বিষাক্ত হয়ে গেছে সভ্যতার অশ্লীল বাতাসে’’।

প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ০৭ জুলাই, ২০২০; দৈনিক আমাদের সময়, ২২ জুন, ২০২০

চাকরিপ্রত্যাশীদের করোনাকাল : সংকট ও দুর্ভাবনা
Scroll to top