হাসান হামিদ
নারীরা এখন কোথায় নিরাপদ বলুন! না ঘরে, না বাইরে। প্রতিদিন খবরের কাগজে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এসবের সংবাদ প্রকাশিত হয়। দিন দিন এই ধরনের অপরাধ বাড়ছে। আজকাল প্রায়ই গণপরিবহনে নানারকম বিশৃঙ্খলা আর যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণের অভিযোগের কথা শোনা যায়। কষ্টের ব্যাপার হলো, এই নৈরাজ্য অবসানের জন্য কোনো পক্ষকেই (সরকার কিংবা পরিবহন মালিক) পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলে কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঈগল পরিবহনে ডাকাতি আর দল বেঁধে ধর্ষণ, এর ঠিক চার দিন পরই গাজীপুরের শ্রীপুরে চলন্ত বাস থেকে স্বামীকে ফেলে দিয়ে এক নারীকে দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বলা যায়, এদেশে প্রায় প্রতিদিন ঘটছে নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের ঘটনা। কিন্তু এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণের কি কেউ নেই?
যতদূর জানি, সড়কপথের নিরাপত্তায় ২০০৫ সালে গঠন করা হয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশ মূলত সড়কে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু ব্যবস্থা নেয়। আর ডাকাতি কিংবা বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে আসামি ধরার ক্ষেত্রে থানা-পুলিশকে সহায়তা করে পুলিশের এ ইউনিট। কিন্তু তল্লাশিচৌকি বসিয়ে কিংবা মহাসড়কে টহল জোরদার করে যাত্রী সুরক্ষায় হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা নেই বললেই চলে। এ জন্য জনবল ও সরঞ্জামের ঘাটতির কথা তারা বলছে। বর্তমানে হাইওয়ে পুলিশের জনবল প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে , ২০০৫ সালে হাইওয়ে পুলিশের যাত্রা শুরুর পর অপরাধ ঠেকাতে দূরপাল্লার রাতের বাসগুলোতে যাত্রা শুরুর স্থানে বাসের ভেতরের অবস্থা (যাত্রীসহ) ভিডিও করা হতো। কিন্তু এখন আর এতে কারও নজর নেই। বাসে ডাকাতি বা অপরাধ কমাতে চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা মহানগর পুলিশ প্রতিটি বাসে একটি বিশেষ যন্ত্র বসানোর পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছিল। এ ব্যবস্থাটা এমন যে বাসে একটি বাটন থাকবে। ডাকাত বা কোনো বিপদ বুঝতে পারলে ওই বাটনে চাপ দিলে যে এলাকায় বাসটি আছে সে এলাকার পুলিশ সুপার, বাসমালিক এবং জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ সাহায্য চেয়ে একটি বার্তা পৌঁছে যাবে। কিন্তু এর কিংবা এ নিয়ে কার্যক্রমের শক্ত অগ্রগতি নেই।
এবার জানা যাক, এ জাতীয় অপরাধ কী পরিমাণ সংঘটিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান কী বলছে? ২০১৬-১৯ সাল পর্যন্ত গণপরিবহনে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির হিসাব সংরক্ষণ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। করোনা মহামারির সময় সেই হিসাব আর রাখেনি সংগঠনটি। সমিতির হিসাবে, ওই চার বছরে গণপরিবহনে ১৩৪টি ধর্ষণ, ৪২টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ৯১টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। শুধু কী তাই, ঢাকার গণপরিবহনে চলাচলের পথে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন শতকরা ৬৩ শতাংশ নারী, তরুণী ও কিশোরী। এদের মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন ৪৭ শতাংশ। এসব ভুক্তভোগীর অর্ধেকই পরবর্তী সময়ে চরম মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির পাশাপাশি ১৫ শতাংশ বুলিং, ১৫ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৫ শতাংশ লিঙ্গবৈষম্য ও ৮ শতাংশ শারীরিক গঠন নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন। শুধু কি তাই, যাত্রী ওঠানো-নামানোর সময় চালকের সহকারীদের নেমে দাঁড়ানোর কথা থাকলেও তারা বাসের দরজায় অবস্থান করে অযাচিতভাবে স্পর্শ করে বলে অভিযোগ করেছেন প্রায় ৬১ শতাংশ নারী। ছয় মাসে অন্তত তিনবার এ ধরনের স্পর্শের মুখোমুখি হচ্ছেন ২৫ শতাংশ নারী।
কিছুদিন আগে আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠানামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাজেভাবে স্পর্শ করা, ধাক্কা দেয়া ও বাজে মন্তব্য। যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। গণপরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীর হাতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা বেশি। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ নারী জটিলতা এড়ানোর জন্য এর প্রতিবাদ করেননি। আরেকটি জরিপ বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে চার হাজার ১৬৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এর মধ্যে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ৭৩৯ জন মারা যায়। বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এ তথ্য উদ্বেগজনক বললেও কম বলা হয়। কিন্তু দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনটিও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই।
পত্রিকায় যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর সূত্র ধরে বলা যায়, আন্তঃজেলা বা দূরপাল্লার বাসে প্রতি বছরই এমন অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। অনেক ঘটনায় ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে কিংবা অন্যভাবে হত্যা করার ঘটনাও আছে। বিগত বছরগুলোতে বাসে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ ঘটনাতেই পরিবহনের চালক-কর্মী এবং তাদের সহযোগীরা যুক্ত। এছাড়া যাত্রীবেশে বাসে উঠে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন বড় বড় মহানগরগুলোতে যেমন বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালু করা দরকার তেমনি আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসের ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে বিভাগীয় এবং জেলাপর্যায়ে সেবাদানকারী বাস কোম্পানিগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা সম্ভব হলে পরিবহন খাতের নৈরাজ্য অনেকটাই কমে যাবে। একইভাবে বাস কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করা দরকার সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী চালক ও চালকের সহকারীসহ সব কর্মীদের নিয়োগপত্র দিয়ে নিয়মিত চাকরির অধীনে নিয়ে আসা। কিন্তু বেশিরভাগ বাস কোম্পানিই এই নিয়ম মানছে না।
আর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় কিংবা বাস মালিকদের সমিতিরও এসব আইন কার্যকর করা নিয়ে কোনোই আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে বিদ্যমান অন্যান্য আইনও মানছেন না গণপরিবহন মালিকরা। যেমন আন্তঃজেলা বাস চলাচলের অনুমোদন পাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে জেলা সদরের নির্দিষ্ট টার্মিনাল থেকেই কেবল যাত্রী তোলা যাবে। এর বাইরে যত্রতত্র যাত্রী তোলা যাবে না। তবে যাত্রী চাইলে বাস থেকে নামতে পারবেন। কিন্তু মালিকদের কাছ থেকে নিয়ে চুক্তিভিত্তিকভাবে বাস চালানোয় বেশিরভাগ চালকই বাড়তি আয়ের জন্য যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী তোলেন। এই পরিস্থিতি বদলে নারীসহ সব যাত্রীর জন্য নিরাপদ গণপরিবহন নিশ্চিত করতে হলে কেবল অপরাধী ধরা আর শাস্তি দিলেই হবে না, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
হয়রানি প্রতিরোধে যেসব কাজ করা দরকার- পরিবহনে আসনের বেশি যাত্রী না তোলা, গণপরিবহনের ভেতর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা করা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নেয়া।