হাসান হামিদ
খাদ্যদ্রব্যের দাম দিন দিন বাড়ছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের পাশাপাশি চালের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট নয়। অন্য বছর এমন মওসুমে চালের দাম কিছুটা কম থাকে। কিন্তু এবার এই সময়েই ধান-চালের যে দাম তাতে আশঙ্কা বাড়ছে, সামনে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে! আবার বিগত বছরের তুলনায় দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন এ বছর কম হয়েছে। এজন্য এবার চালের ঘাটতি থাকবে বেশ। আর এটাই স্বাভাবিক যে, এই ঘাটতি পূরণে নির্ভর করা হবে আমদানি করা চালের ওপর। চাল আমদানি করেও দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেখানে কঠিন, সেখানে যদি বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত দেয় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশের জন্য এটি অনেক বড় দুঃসংবাদ।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে তীব্র খাদ্যসংকটের মধ্যে পড়েছে বিশ্বের ২৪ দেশের ১৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিশ্বের ৮টি দেশের ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ খাদ্যসংকটের মুখে পড়েছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংকটের কারণে খাদ্যসংকটের মধ্যে পড়েছে ২১টি দেশের ৩ কোটি মানুষ। ফলে সংশয় দেখা দিয়েছে, এভাবে খাদ্যসংকট বাড়তে থাকলে পৃথিবীজুড়ে দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ। আর এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশেও। তাহলে খাদ্য সংকট কি আসন্ন- এমন একটি প্রশ্ন আজকাল ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনেই।
বিশ্বে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হতে পারে এই সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসংঘ। অন্যতম কারণ হিসেবে তারা বলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন খবর ও তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ইউক্রেন ও রাশিয়া বিশ্বব্যাপী খাদ্যের ১০ ভাগের এক ভাগ সরবরাহ করে। তারা বিশ্বের গম রফতানির ৩০ শতাংশের পাশাপাশি সূর্যমুখী তেলের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে। কমপক্ষে ২৬টি দেশ তাদের অর্ধেকেরও বেশি খাদ্যশস্যের জন্য রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সংঘাতের ফলে ইউক্রেনের খাদ্য উৎপাদন থমকে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, বন্ধ হয়ে গেছে খাদ্যশস্য রফতানি। গত বছরের জুলাইতে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রাশিয়া বিশ্ব চাহিদার ১৬ শতাংশ গম রফতানি করে। এক্ষেত্রে ইউক্রেনের অবদান ছিল ১০ শতাংশ। কিন্তু সংঘাত ছড়িয়ে পড়ায় দেশ দুটি শস্য রফতানি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়। এদিকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কুয়েত থেকে কাজাখস্তান পর্যন্ত অন্তত ২৩টি দেশ খাদ্য রফতানিতে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করেছে। মূলত, অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই দেশগুলো এমন সিদ্ধান্ত নেয়। সার রফতানি সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এখন বাণিজ্য থেমে গেলেই দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার তথ্য বলছে, যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের ২০-৩০ শতাংশ জমি ২০২২ সালের মৌসুমে অনাবাদী বা চাষের আওতার বাইরে থেকে যাবে। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন। চলতি সপ্তাহের শুরুতেই গমের দাম বেড়েছে ৫৩ শতাংশ। আরও ৬ শতাংশ বেড়ে যায় ভারতের গম রফতানি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের পর। কয়েক দিন আগে জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর এক বক্তব্যে বলেছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে রপ্তানি স্বাভাবিক না হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে। রাশিয়ার হামলার কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলো দিয়ে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এসব বন্দর দিয়ে বিপুল পরিমাণ সূর্যমুখী তেল, গম ও ভুট্টা রপ্তানি হতো। এগুলো বন্ধ হয়ে পড়ায় এখন বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যাপক কমেছে এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী এসব পণ্যের দাম ব্যাপক বেড়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম ইতোমধ্যেই সারাবিশ্বে বেড়েছে অন্তত ৩০ শতাংশ।
‘দ্য ইকোনোমিস্ট’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা ইতোমধ্যে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর ওপর প্রভাব পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি ঘাটতির। বিশ্ব যখন সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যস্ত ঠিক তখনই শুরু হল রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ। যা খাদ্য সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। এরই মধ্যে দেশে দেশে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়। ইকোনোমিস্ট আরও বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে নতুন করে শত শত কোটি মানুষ দারিদ্রের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে ইতোমধ্যে এক বেলা খেলে আরেক বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১৬০ কোটি। দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে প্রায় ২৫ কোটি। পাশাপাশি দারিদ্র্যতার মধ্যে পড়তে পারে আরও কয়েক কোটি মানুষ।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রধান খাদ্যশস্য কম-বেশি চালের সংকট দেখা দিয়েছে অনেকবার। যদিও বরাবরই বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। কিন্তু পরিসংখ্যান কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ আসলে খাদ্য আমদানিনির্ভর একটি দেশ। যতখানি গম দরকার এর প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি করতে হয় আমাদের। চালেও বাংলাদেশ ক্রমাগত আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। সূত্র বলছে, বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বোচ্চ চাল আমদানিকারক দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল। ২০২১ সালের তথ্য বলছে, ২৬ লাখ টনের বেশি চাল আমদানি করেছে বাংলাদেশ। যা চাল আমদানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে গেছে আমাদের।
বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য মজুত করার মতো গুদামের ধারণক্ষমতা ২০ লাখ টনের কিছু বেশি। অর্থাৎ প্রতিবছর সরকার খাদ্য চাহিদার ৫ শতাংশেরও কম মজুত করে। এত সামান্য পরিমাণ খাদ্য সংরক্ষণ করে খাদ্যের বাজারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ সরকারের থাকে না। এ বছর সরকারের খাদ্য মজুতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। গত ২২ মে পর্যন্ত সরকারের কাছে মোট ১১.৫৯ লাখ টন খাদ্যশস্য রয়েছে। এর মধ্যে ১০.৫১ লাখ টন চাল এবং মাত্র ১ লাখ টনের কিছু বেশি গম রয়েছে। আবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, গত অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টন। সে হিসাব আমলে নিলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ বছর সাড়ে ৫৫ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু উল্টো এ পর্যন্ত ৩০ লাখ টন চাল আমদানির প্রয়োজন হয়েছে ঘাটতি মেটাতে।
তথ্যের এমন গরমিলের সাথে রয়েছে ব্যবসায়ীদের নানা কারসাজি। আমাদের দেশে গড়ে প্রতিদিন ৭ কোটি কেজির বেশি চাল লাগে। এখন কেজিপ্রতি চালের দাম মাত্র ১ টাকা বাড়লেও প্রতিদিন বাজার থেকে ৭ কোটি টাকা উঠিয়ে নেওয়া যায়। বাজারে যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় থাকে না, এই সুযোগ ব্যবসায়ীরা নেন। আর এর জন্য ভোগান্তি বাড়ে সাধারণ মানুষের। আসল কথা হলো, দেশে এবার পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদিত হয়নি এবং যেটুকু হয়েছে সেটা দেশের খাদ্য সংকট মোকাবিলার জন্য যথেষ্টও নয়। ব্যবসায়ীদের কাছে খাদ্য মজুত থাকলেও মানুষের চরম খাদ্য সংকট হতে পারে। সেরকম পরিস্থিতি ঠেকাতে হলে সরকারের খাদ্য মজুত বাড়াতে হবে। কিন্তু এমন কোনো প্রস্তুতি আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ?