সাধারণত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগকে সংক্ষেপে এসএমই বলা হয় যার মানে হলো স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ। বাংলাদেশের শিল্পনীতি-২০১৬ সালের সংজ্ঞা অনুয়ায়ী ১৬ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মীর প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যখন এই খাতকে অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে মুখে মুখে তেমন বলা হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। এ দেশে যারা সম্পদশালী তারা অসৎ পথে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষমতা ভোগের সুবাদে কর ফাঁকি দিচ্ছেন অনেক বছর ধরেই। আর এখন সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরোক্ষ করের ফরমান নিয়ে এনবিআর চড়াও হচ্ছে সাধারণ ভোক্তার ওপর। গত ৯ জুন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এতে করপোরেট করসহ ধনীদের সুবিধা হয় এমন আরও বেশকিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করের হার কমিয়ে আনা হয়েছে। বিপরীতে বাড়ানো হয়েছে নানা মাত্রার পরোক্ষ কর। ফলস্বরুপ এর প্রভাব পড়বে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ওপর। সম্পদশালীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে জনগণের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা তথা ভ্যাটের খড়গ চাপানোটা কি জনগণকে শোষণ করার শামিল নয়? অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানের ১৯(২) অনুচ্ছেদ বলা আছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
বাংলাদেশে এসএমই খাত কেন দিন দিন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে? এর একটি বড় কারণ হলো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চান না। কিন্তু এই খাতে বিনিয়োগ তো লাগবে। অভাব টাকার। বাধ্য হয়ে অনেক ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তারা নির্ভর করেন এনজিও মাইক্রো ফাইন্যান্স ইনস্টিটিশনের ওপর। কিন্তু এখানে অতি উচ্চ হারে সুদ দিতে হয়। ব্যাংকগুলো কেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না? কারণ এ খাতে ঋণ দেওয়াকে তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। অল্প অল্প করে অধিক মানুষকে ঋণ দিতে হয়, এতে সুপার ভিশনে অনেক সময় ব্যয় হয় এসব অজুহাত দেখিয়ে ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র বিনিয়োগে কম যায়। আর এতে ভুক্তভোগী হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে বড় সংকট তৈরি হয়েছিল করোনা মহামারির সময়। মোটা দাগে বললে, করোনার ধাক্কা শিল্প খাত যত আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেগেছে এই খাতে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) একটি প্রতিবেদন সেই তথ্যই জানাচ্ছে। রিপোর্টে খুব পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। আইএফসি বলছে, বাংলাদেশের ২ কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের। এই খাতে ৩৭ ভাগ কর্মী করোনা মহামারির কারণে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে করা এক জরিপে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতের শতকরা ৯৪ ভাগ প্রতিষ্ঠানে বিক্রি কমেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) ‘কোভিড-১৯ এবং বাংলাদেশে ব্যবসায় আস্থা’ শীর্ষক জরিপে উঠে এসেছে, ৭৯ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করোনা সঙ্কট কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা পায়নি। এর মধ্যে আবার ৬৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো টাকাই পায়নি। আর প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে কিছুই জানে না ১৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক। এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ছোট প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের টাকা কম পেয়েছে।
সূত্র বলছে, এসএমই ফাউন্ডেশন ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার মধ্যে ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। জানা যায়, বিতরণকৃত ঋণের ৬৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ পুরুষ উদ্যোক্তা এবং ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। আর বিতরণকৃত ঋণের ৮০ দশমিক ২৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ঢাকার বাইরের। এরপর ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রণোদনার ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় অর্থ বিভাগ। দেশের পল্লী ও প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হয়েও তা যথেষ্ঠ নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দেখা যায়, ২০২০ সালের জুলাই থেকে করোনা মহামারি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে প্যাকেজ দেওয়া হয় তাতে ছোট-বড় সব সেক্টর অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় ছিল। কিন্তু রপ্তানিখাত এবং বৃহৎ শিল্পখাতে দ্রুত প্যাকেজের অর্থ বিতরণ হলেও এসএমই খাতে আশানুরূপ হারে অর্থ বিতরণ হয়নি।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শ্রমিক এসএমই খাতে জড়িত। এ দেশে ৪৬ হাজার ২৯১টি শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে, যার ৯৩ ভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান। অন্য এক সমীক্ষা বলছে, ছোট ব্যবসা, অল্প পুঁজি, লাভ- লোকসানের হিসাব খুব বেশি নয়; দেশে এমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সংখ্যা ৭৭ লাখের বেশি। সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতে কমপক্ষে ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ কর্মে নিয়োজিত। এই এসএমই খাত যত বড় হবে, কর্মসংস্থানও তত বাড়বে। তারপরও এ দেশে এসএমই খাতকে অবহেলা করা হয়, গুরুত্ব দেওয়া হয় বড় শিল্পখাতকে। নইলে প্রায় ৬৫ বছর ধরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের কাজ শুরু হলেও এর বিকাশ এই অঞ্চলে সেভাবে হয়নি। ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়, ১৯৫৭ সালই থেকেই এ খাতে কাজ করে যাচ্ছে ক্ষুদ্র, কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান। এত দিনে যে সফলতা এসেছে তার সূত্র ধরে বলা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ অবদান এসএমই খাতের। অথচ জেনে অবাক হতে হয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এর অবদান ৪৫ শতাংশ। আর চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপিতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ অবদান রাখছে এসএমই খাত। এই দেশগুলোর বেশির ভাগ কর্মসংস্থানও এসএমই খাতে।
মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশে বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে। অথচ কর্মসংস্থান সৃষ্টির বড় সুযোগ ও ক্ষেত্র হচ্ছে এসএমই খাত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড এমপ্লমেন্ট রিসার্চের গবেষণায় বলা হয়, উচ্চ শিক্ষিত, শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার ১৬.৪ শতাংশ। আর পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে শ্রমশক্তি বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। বাংলাদেশে এখন ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ। বিশাল এই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে এসএমই শিল্পখাতের বিকাশ ও প্রসারের বিকল্প নেই। তাছাড়া দারিদ্র্য বিমোচনের বড় হাতিয়ার হলো এসএমই খাত। টেকসই উন্নয়নে পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় এসএমই খাতের যথেষ্ঠ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ খাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যথাযথ নীতি-কৌশল গ্রহণ ও বাস্তবায়ন জরুরি।