হাসান হামিদ
বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন দুইশো’র বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রতিদিন দশ থেকে বারো হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এই ভাইরাসে। এরপরও এই পরিস্থিতিতে ১৫ জুলাই থেকে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। অথচ তা মোটেই ঠিক হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর বিধিনিষেধ টানা ৪ সপ্তাহ থাকলে খুব ভালো ফলাফল আসতো। আর লকডাউন শিথিলের ঘোষণা আসতে না আসতেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় নেমেছে। যেন করোনা আর দেশে নাই! ব্যাপারটা এমন, কাউকে এ ব্যাপারে বলতে গেলে উল্টো কথা শুনতে হয়। মনে হয়, আমি যে সাবধান থাকছি, বের হচ্ছি না, হুটহাট কোথাও যাচ্ছি না; এটা আমার একটা অপরাধ। আসলে বলার কিছু নাই। যে দেশের মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে সরকারকে সেনাবাহিনী রাস্তায় নামাতে হয়, সেই জাতি ভুগবে সেটাই স্বাভাবিক। কিছু আছে অর্ধমুর্খ ধার্মিক, করোনা কিছু করতে পারবে না এসব বলে বেড়ায়; অথচ মহামারীতে করণীয় সম্পর্কে কুরআন হাদিসে স্পষ্ট বলা আছে। জীবিকার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে বের হলে অন্য কথা। খারাপ লাগে যখন দেখি জীবিকার প্রয়োজন ছাড়াও অনেকে বের হন। কিন্তু ভাবা উচিত, আপনি এখন ঘর থেকে শুধু শুধু বের হচ্ছেন মানে আপনার কিছু না হলেও করোনা বিস্তারে আপনি সহায়তা করছেন। এর মানে আপনি সমাজ এবং দেশের ক্ষতি করছেন।
বর্তমানে দেশে করোনার বিস্তার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে করোনা সংক্রমণের দিক থেকে ৩১তম বেশি সংক্রমণের দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমরা জেনেছি, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়ায়। এজন্য প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এই করোনা থেকে বাঁচতে আমরা নানা সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করছি। ব্যবহারের পর ভয়ানক ঝুকিপূর্ণ এসব বর্জ্য আমরা আসলে কীভাবে কোথায় ফেলছি তা কি ভাবছি? বাসার বাইরে হাসপাতাল এসব সরঞ্জাম অনেক বেশি। অন্যান্য মেডিক্যাল আবর্জনার সাথে যুক্ত হয়েছে করোনা বর্জ্য। প্রায় সবাই এখন মাস্ক, গ্লাভস ও গগলস ব্যবহার করছেন এরপর যত্রতত্র তা ফেলে দিচ্ছেন বা গৃহস্থালি বর্জ্যের ঝুড়িতে রাখছেন। এই জিনিসের ব্যবস্থাপনায় নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। নাগরিকেরা যেন সুরক্ষাসামগ্রীর বর্জ্য আলাদা পাত্রে ভরে তা ফেলেন সে ব্যাপারে সচেতন করার কোনো কার্যক্রম নেই। বরং এ নিয়ে উদাসীনতার নানা খবর পত্রিকায় আসছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক কোভিড মহামারিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা বর্জ্য নিয়ে গবেষণা করেছে। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড মহামারিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসা বর্জ্যের মাত্র ছয় দশমিক ছয় ভাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা হয়। বাকি ৯৩ ভাগ পড়ে থাকছে আমাদেরই আশপাশে! করোনার বর্জ্যের ঝুঁকি বিবেচনায় সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২০ সালের ১৩ জুন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে ৫টি নির্দেশনা মানতে চিঠি দিয়েছিল। সেসব নির্দেশনায় প্রত্যেক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে করোনা বর্জ্য আলাদা করার প্রক্রিয়া নিয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলা হয়। বলা হয়, দুই স্তর বিশিষ্ট প্লাস্টিক ব্যাগের দুই-তৃতীয়াংশ এসব বর্জ্য ভর্তি করে ব্যাগের মুখ ভালোভাবে বেঁধে আলাদা বিনে রাখতে হবে, বিনের গায়ে লেখা থাকতে হবে- কভিড-১৯ বর্জ্য। খবর নিয়ে জেনেছি, সরকারি হাসপাতালগুলোতে অল্প সংখ্যক পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিলেও দুই একটি ছাড়া কোনো বেসরকারি হাসপাতালে এমন কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য অপসারণের কোনো তাগিদও নেই।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন দেশব্যাপী ১ হাজার ৭০০ জনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি জরিপ করেছে। তাদের প্রতিবেদন বলছে, গত এক মাসে দেশে মাস্ক, গ্লাভসসহ মোট প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ টন। এর মধ্যে সার্জিক্যাল গ্লাভস ও মাস্ক ছিল দুই হাজার টনের কাছাকাছি। এই বর্জ্য কোথায় যাচ্ছে? কীভাবে যাচ্ছে?
পত্রিকায় পড়লাম, দেশের বেশিরভাগ বিশেষত শহরে মানুষজন তাদের ব্যবহৃত করোনা সুরক্ষার সরঞ্জামগুলো গৃহস্থালি বর্জ্যের ভ্যানে ফেলেন। আর তাতে কী ঘটে। কেবল ঢাকা সিটির উদাহরণ দিই। জানা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এসব বর্জ্য ভ্যানে তুলে নিয়ে যান প্রায় ১২ হাজার বেসরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আবর্জনা নাড়াঘাঁটা করেন। ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া মাস্ক-গ্লাভস-গগলস-পিপিইগুলো এভাবে তাদের সরাসরি সংস্পর্শে আসে। আর এভাবে সংক্রমণের প্রত্যক্ষ ঝুঁকিতে আছেন তারা। আবার এই কর্মীরা প্রতিদিন নগরীর প্রায় সবকটি বাড়িতে যাচ্ছেন। তারা এলাকার জন্য নির্ধারিত ময়লাঘর আর কনটেইনারে বর্জ্য রেখে যাওয়ার পর করপোরেশনের কর্মীরা সেগুলো নিয়ে ফেলেন ভাগাড়ে। সেখানে মহানগরীর দেড় কোটির বেশি বাসিন্দার নিত্যদিনের মাছ-মাংস-সবজির আবর্জনা আর আরও হাজারো বর্জ্যের সঙ্গে পড়ে থেকে গণসংক্রমণের ঝুঁকি ছড়াচ্ছে তাদের ব্যবহৃত করোনা সুরক্ষার সরঞ্জামগুলো। ঢাকার মতো অন্যান্য শহরেও প্রায় একই অবস্থা। কিন্তু এতে যে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তা কি কেউ ভাবছেন?
জানতে পেরেছি, মেডিক্যাল বর্জ্য নিয়ে কাজ করে একটিমাত্র বেসরকারি সংগঠন- প্রিজম বাংলাদেশ। ঢাকার সরকারি-বেসরকারি ২৭টি হাসপাতালের সঙ্গে কাজ করছে এ সংগঠন। এগুলো থেকে কোভিড বর্জ্য সংগ্রহ হয় প্রায় দুই হাজার কেজি! জানা যায়, সারাদেশে চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪৮ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার মাত্র ৩৫ টন ব্যবস্থাপনার আওতায় ছিল। এর অধিকাংশই ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আবার মাস্কসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করছে ৭১ ভাগ মানুষ। তাদের মাস্ক ও অন্যান্য করোনা বর্জ্য পুরোটাই গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে এসেছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও জানিয়েছেন, তারা প্রায় সব বাড়ি থেকেই গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে মাস্ক ও গ্লাভস পাচ্ছেন।
আমরা বুঝতে পারছি, হাসপাতালগুলোর করোনা বর্জ্য শহরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া হাসপাতালগুলো যথাযথ পদ্ধতিতে বর্জ্য রাখছে না। এজন্য সংক্রামক বর্জ্য সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সব কর্মীকে। করোনা বর্জ্য এবং হাসপাতালের সব ধরনের বর্জ্য বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ডিসপোজ করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ে একটি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনা বর্জ্য মূলত ‘সংক্রামক বর্জ্য’। তাই আমাদের উচিত করোনা বর্জ্য যেন পরিবেশে ছড়িয়ে সংক্রমণ বাড়াতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা। আর করোনা মহামারী যেহেতু এই পরিবেশ বিপর্যয়ের ফল; সেহেতু পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সচেতন হতে হবে। তা না হলে আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে আগামীর অন্য কোনো বিপর্যয়। বর্তমান শতাব্দীর জলবায়ু রক্ষা কিংবা পরিবেশ বাঁচাও এসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে করোনা ভাইরসা আমাদের জন্য নিয়ে এসেছে নতুন এক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রধান হাতিয়ার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক সমকাল, ২৭ জুলাই, ২০২১; সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ২৯ জুলাই, ২০২১