করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

হাসান হামিদ

করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পড়াশোনায় কম-বেশি বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। এই যে শিক্ষায় বিশ্বব্যাপী এমন ব্যাঘাতের ঘটনা ঘটেছে এর মানে হচ্ছে কয়েক কোটি শিশু শ্রেণিকক্ষে থাকলে যে একাডেমিক জ্ঞান অর্জন করত তা তারা করতে পারেনি। উন্নত দেশে নানা ভাবে সেটি থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে হাওরাঞ্চল, চরাঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল এবং শহরের বস্তি এলাকায় বসবাস করা পরিবারের শিশুরা একাডেমিক শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ার পর এদের একটা অংশ আর স্কুলমুখী হয়নি। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য বলছে, শুধু একাডেমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া নয়, দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় এসব শিশুদের একটা অংশ নানামুখী অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে গেছে; অর্থাৎ তাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। আশঙ্কা এটাই, সিলেবাস ছোট করেই আমরা মনে করছি আমাদের শিক্ষার ক্ষতি বুঝি পুষিয়ে দেওয়া গেল! আসলেই কী তাই? গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ, এ থেকে উত্তরণ এসব নিয়ে কে ভাববেন? এদেশে কৃষি কর্মকর্তার সাথে কৃষকের যেমন খুব একটা যোগাযোগ নেই, শিক্ষক কিংবা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বেশিরভাগের শিক্ষা নিয়ে ভাবনা অতোটা নেই; চাকরিটা করেই তৃপ্ত তারা। শ্রেণিকক্ষে কোনো রকম পড়িয়ে শিক্ষক তাঁর কর্তব্য শেষ করছেন, সরকারি অফিস আদেশ পালন করেই শিক্ষা কর্তারা ক্লান্ত। কেরানীর কাজের সাথে এ দেশের অফিসারদের কাজের পার্থক্য কোথায়? শিক্ষা নিয়ে স্বপ্ন দেখেন এমন কর্তা এই খাতে বিরল। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে, এর দায় কি কিছুটা হলেও এই খাতের সংশ্লিষ্টরা নিবেন না?

পত্রিকায় দেখলাম, ২০২৩ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হবে। বর্তমানে যে শিক্ষাক্রম চলছে এর সাথে নতুন শিক্ষাক্রমের পার্থক্য কী? বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চেয়ে জোর দেওয়া হয়েছে শিখনকালীন মূল্যায়নে। এর মানে হচ্ছে শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন। এ নিয়েই আশঙ্কা। কারণ স্কুল গত রমজান মাসে কয়েক দিন খোলা রাখার সিদ্ধান্তে অনেক শিক্ষককে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখেছি, তাতে এ শঙ্কা অমূলক নয়। আর বিভিন্ন সময়ে উঁচু বেতন স্কেলের জন্য অনেককে সোচ্চার হতে দেখি, দেশ যখন বৈশ্বিক শিক্ষা সূচকে তলানিতে অবস্থান নেয়, এ নিয়ে শিক্ষা খাতের কাউকে একটা মন্তব্য করতে দেখি না। ঢাকা শহরে প্রত্যেকটা গলিতে কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে কেন? স্কুল-কলেজে পড়াশোনা ঠিকমতো হয় না বলেই বেশিরভাগ অভিভাবক মনে করেন। এ থেকে মনে হয় সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে তা বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হবে। আর আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা্র সব কার্যক্রম শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অসম অনুপাত নিয়ে চলছে। উন্নত দেশগুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১২/১৫, আর বাংলাদেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩৫। এটি সুষ্ঠু শিক্ষাদানে বড় বাধা, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিক্ষা বাজেটে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের ব্যবধান কমানোর জন্য একটি যুগোপযোগী বরাদ্দ থাকা দরকার বলে মনে করি।

আসন্ন অর্থবছরে (২০২২–২৩) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাখাতে টাকার অংকে মোট বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি অর্থ বছরের তুলনায় আসন্ন অর্থ বছরে মোট ৯ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য আসন্ন অর্থ বছরে মোট ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৭১ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য এবার ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি অর্থ বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা এ বছরের জন্য করা হয়েছিল ৩৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা চলতি অর্থ বছরে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যেসব খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষাখাত। ১৯৭২ সালে মোট বাজেটের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের হিস্যা ছিল ২২ শতাংশ। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাখাতে জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ দিতে চেয়েছিলেন। তার সময়ে তৈরি কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন তাদের রিপোর্টে বলেছিল, শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ৫-৭ শতাংশ দরকার। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো) দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে আসছে। তবে একবারে এই বরাদ্দ ২০ শতাংশ দেওয়া সম্ভব না হলে অন্তত জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলেছিলেন শিক্ষাবিদরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত মিলে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল। তবে একক খাত হিসেবে শিক্ষায় এই বরাদ্দ ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত অর্থবছরেও শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আগামী অর্থবছরেও টাকার অঙ্কে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও তা ১২ শতাংশের আশপাশেই থাকবে।

২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। নানা সময়ে হয় লকডাউন। শিক্ষা কার্যক্রম অন্য সবকিছুর মতোই বন্ধ হয়ে যায়। মাঝখানে ইন্টারনেটভিত্তিক যে অনলাইন শিখন চালু হয়, তাও নানা প্রতিবন্ধকতায় খুব সফল হয়েছে বলা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে সেই সক্ষমতা নেই। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে দীর্ঘ ১৮ মাস পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একসময় খুলে দেয়া হয়। অবশ্য শ্রেণি কার্যক্রম সেই সময় স্বল্প পরিসরে চালু করা হয়। সিলেবাস ছোট করা হয় দফায় দফায়। এরপর ২০২১ সালে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেলে আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এভাবে সীমিত আকারে বন্ধ-খোলা এসব চলতে থাকে। সর্বশেষ ২০২২ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেও ছুটি শুরু হয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে। স্কুল বন্ধ থাকার সময়সীমা পরবর্তীতে আরও দুই সপ্তাহ বাড়ে। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে দূরে থাকে দীর্ঘ একটা সময়। এভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় এই সংকট তৈরি হয়।

করোনাকালীন দীর্ঘ সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে বাংলাদেশ সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বলা যায়। বর্তমান সরকারের পাশাপাশি কয়েকটি উন্নয়ন সংস্থাও এগিয়ে এসেছে এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে। যেমন বিশ্ব ব্যাংকের মাধ্যমে ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন’ (জিপিই) ‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯ স্কুল সেক্টর রেসপন্স (সিএসএসআর)’ প্রকল্পের আওতায় ১৪ দশমিক আট মিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২০ কোটি টাকা অনুদান দিচ্ছে বলে জেনেছি। এই প্রকল্পের আওতায় মোট ২৫ লাখ শিক্ষার্থীকে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির পুরো শিক্ষাবর্ষের জন্য ৩৫টি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা হবে। এসব কনটেন্ট স্থবির হয়ে পড়া শিক্ষাব্যবস্থাকে বেগবান করতে সাহায্য করবে বলে আশা করি।

এশিয়ায় শিক্ষা খাতের ওপর ‘কোভিড-১৯ এর প্রভাব ও মোকাবিলা কার্যক্রমবিষয়ক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ইউনিসেফ এবং ইউনেস্কো যৌথভাবে। তারা এটি প্রকাশ করে ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের প্রথম দিকে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর এবং দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়াসহ এশিয়ার প্রায় ৮০ কোটি শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালের আগস্টে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে লম্বা সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশে ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স-২০২০ এর একটি সমীক্ষাও বলছে, বাংলাদেশে একটি শিশু প্রাক-মহামারিকালে চার বছর বয়সে স্কুল পড়া শুরু করে সর্বোচ্চ ১৮ বছরের মধ্যে স্কুলজীবন শেষ করে থাকে। কিন্তু এ মহামারিকালে শিশুদের স্কুল শুরু করতে হচ্ছে প্রায় ৫-৬ বছর বয়স থেকে। ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থেকে শুরুতেই দু-তিন বছর হারিয়ে যাচ্ছে।

স্বস্তির কথা হলো, বর্তমানে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পুরোদমে চলছে। তবে মহামারি চলাকালীন যেসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছিল, অসম শিখন সমস্যা যাদের পিছিয়ে দিয়েছে তাদের নিয়ে ভাবতে হবে। মাথায় রাখতে হবে করোনার কারণে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সব মিলিয়ে করোনার কারণে শিক্ষায় বিশাল আকারের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সরকারকে শিক্ষাব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি চালাতে হবে ই-শিখন কার্যক্রম।

করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top