বলা যায়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ অনেকটাই সামলে উঠেছে বাংলাদেশ। কয়েক সপ্তাহ যাবত আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণের হার নিম্নমুখী। কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, সংক্রমণের হার দশ শতাংশের নিচে। এটি যেমন স্বস্তির, তেমনি সামনে এর তৃতীয় ঢেউ আসছে; এ ব্যাপারটি নিদারুণ আশঙ্কার। পশ্চিমা দেশগুলোর অভিজ্ঞতা ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তৃতীয় ঢেউয়ের প্রস্তুতি থেকে বাংলাদেশেও তৃতীয় দফায় ভাইরাস সংক্রমণের আরেকটি ধাক্কা আসার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর সেটি মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতিও প্রয়োজন বলে মনে করি। আমরা দেখছি, বিধিনিষেধ শিথিলের পর রাজধানীসহ সারাদেশের চিত্র এখন স্বাভাবিক। মানুষের চলাচলে বোঝার উপায় নেই দেশে করোনা ভাইরাস আছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভুলে গেছে স্বাস্থ্যবিধিও। গতকাল দৈনন্দিন বাজার করতে একটি সুপারশপে গিয়ে দেখি, ভিতরে প্রবেশের সময় মাস্ক পরলেও ঢুকার পর তা খুলে ফেলছে অনেকেই। আসলে নাক, মুখ ঢেকে মাস্ক পরার যে নিয়ম তা বেশির ভাগ লোকই মানছে না। সব কিছু স্বাভাবিক হোক, তা আমরাও চাই। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে যে তৃতীয় ঢেউ আসার কথা শুনছি, তা সামলানো কঠিন হবে।
ভাবনার মূল জায়গাটি হলো, সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউয়ে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। ভারতের প্রখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন ডা. দেবী শেঠি সম্প্রতি তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রথম ঢেউয়ে কোভিড মূলত বয়স্কদের আক্রান্ত করেছিল। তরুণরা রক্ষা পায় তখন। কিন্তু, দ্বিতীয় ঢেউ বিপুল সংখ্যক তরুণকে আক্রান্ত করেছে। তৃতীয় ঢেউয়ে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্করা ইতোমধ্যেই সংক্রমিত বা টিকা পেয়েছেন।’ এদিকে আমাদের দেশে রোববার থেকে সীমিত পরিসরে স্কুল খোলা হয়েছে। এ অবস্থায় তৃতীয় ঢেউ নিয়ে একটু চিন্তা হওয়া অমূলক নয়।
খবরের কাগজে পড়লাম, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কমিটির রিপোর্টে আসন্ন তৃতীয় ঢেউ শুরুর বিষয়ে জানানো হয়েছে। ওই ঢেউ আগামী অক্টোবরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠবে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। এবারের ঢেউতে প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুরাও ঝুঁকিতে আছে বলে জানানো হয়েছে। গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা ও তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি, ভারতে করোনার সংক্রমণের উঠানামার সঙ্গে আমাদের দেশের সংক্রমণও অনেকটাই প্রভাবিত। সবাই জানি, বাংলাদেশে এই বছর দ্বিতীয় দফা লকডাউনের কারণ ছিল ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনার ভয়াবহ রূপ আমরা দেখেছি। আর আসন্ন তৃতীয় ঢেউয়ের ফলে দেশে আবারও আগের পরিস্থিতি ফিরে আসতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অক্টোবরে থাকবে দুর্গা পূজার মৌসুম। এই অক্টোবর শেষেই করোনার আসন্ন ঢেউ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠবে। এ সময়ে এই পরিস্থিতিতে শিশুদের বিশেষত কোমর্বিডিটি (নানা রকম অসুখ-বিসুখ) থাকা শিশুদের নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তাদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিতের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যদি তাই হয়, তবে বাংলাদেশে অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে আবার বাড়তে পারে করোনা সংক্রমণ, শুরু হতে পারে উল্লেখিত তৃতীয় ঢেউ। কিন্তু স্কুল-কলেজ খোলা থাকায় এবং আসন্ন ঢেউয়ে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকায় বিষয়টি নিয়ে ভাবা এখনই জরুরি হয়ে পড়েছে। কোভিড পরিস্থিতি ভালো থাকা অবস্থায় সরকারের উচিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো দূর করা এবং সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউয়ের জন্য প্রস্তুত হওয়া।
করোনার তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এখনই চিন্তা করা দরকার। এই মুহূর্তে সংক্রমণ কম থাকার কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব ঘাটতি আছে সেগুলো চিহ্নিত করে পূরণ করতে হবে। যাতে তৃতীয় ঢেউ এলেও লকডাউনের মতো পরিস্থিতিতে যেতে না হয়। লকডাউন দিলে সংক্রমণের মাত্রা কমবে, এটা সবাই জানি। কিন্তু করোনা নিয়ন্ত্রণে এটা কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে না। আমাদের মনে আছে, আগের উনিশ দিনের টানা লকডাউনে দরিদ্র মানুষেরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন যাপন করেছে। অনেকে চাকরি হারিয়ে বেকার হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ ছিল। লকউাউনে শুধু সরকারি চাকরিজীবীরা মাসিক বেতন পেয়েছে। অন্যরা বেতন পায়নি বা কম বেতন পেয়েছে। ফলে দিনের পর দিন লকডাউন কোনো সমাধান নয়, এটা বাস্তব কথা।
করোনার প্রকৃত অবস্থা দেশে এই মুহুর্তে কেমন তা বোঝার জন্য অবিলম্বে বিভিন্ন এলাকায় একটি সেরোসার্ভিলেন্স পরিচালনা করা উচিত। সরকার সেটি করতে পারে। সেরোসার্ভিলেন্স সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি মাত্রার অনুমান করতে সাহায্য করে। এটি সরকারকে একটি বৈজ্ঞানিক প্রজেকশন করতে এবং সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করবে। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বল দিক চিহ্নিত করে সরকারের অবিলম্বে সেগুলো ঠিক করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পাশাপাশি সরকারের উচিত নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে মাস্ক পরা এবং ঘন ঘন হাত ধোয়ার ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালানো। একইসঙ্গে টিকা অভিযান ত্বরান্বিত করতে হবে আমাদের। যত দ্রুত অধিক সংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া হবে, তত তাড়াতাড়ি নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এখনো করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নই। সংক্রমণের মাত্রা এখনো পাঁচ শতাংশের নিচে আসেনি। স্বাস্থ্যবিধির ওপরই তাই বেশি জোর দিতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে, মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার কাজটি সবসময় যেন সকলে করে। বাইরে যারা মাস্কবিহীন চলাফেরা করবে তাদের ব্যাপারে প্রশাসনকে আরো জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক এটি বাস্তবায়ন করতে হলে কঠোর হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এজন্য মাস্ক না পরলে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে। আর জরুরি সবাইকে টিকার আওতায় আনা। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করলে সামনের দিনগুলোতে আরও মহাবিপদ অপেক্ষা করছে, এই কথাটা সর্বস্তরের জনগণকে বুঝিয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।
বড় কোনো ঝড় হওয়ার আগের লক্ষণ হল পরিস্থিতি স্থির হওয়া। এখন করোনা সংক্রমণের মাত্রা স্থির থাকার মানেই হলো সামনে ঝড় আসন্ন। আর বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের শুরুতে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। আগের দুই দফা সামাল দেয়া সম্ভব হলেও আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানি, তাহলে এবার তা নিয়ন্ত্রণ বেশি কঠিন হবে। কারণ আগের দুই দফায় শিশুরা আক্রান্ত কম বা না হলেও এবার তা নিয়েই শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের পাশাপাশি সুশৃঙ্খলভাবে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও জোরালো ভ্যাকসিন কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবার যে চেষ্টা করছে, আসুন আমরা সবাই তাতে সহযোগিতা করি। গতবছর এবং চলতি বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিই নিজেরাও। সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে দেশ আবারও মৃত্যুর মিছিলের মুখোমুখি হবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
প্রকাশিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১