হাসান হামিদ
আমাদের দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রায় সবার অসন্তুষ্টি আছে। এই ব্যাপারটা এক দিনের তৈরি না। এরপরও সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রদান করা করোনার টিকার প্রথম পর্যায় সুশৃঙ্খলভাবে হওয়ায় আমরা আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম। আমরা দেখেছি, কত সুন্দরভাবে টিকা দেওয়ার প্রথম পর্যায় অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করার পর টিকা দান কেন্দ্রে বুথে এসে টিকা নিচ্ছে মানুষ। কোনো ভোগান্তি নেই। অনেকটা আসুন, বসুন, ইনজেকশন নিন এরপর নিশ্চিন্তে চলে যান টাইপের ব্যবস্থা। প্রথম পর্যায় এ রকম সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হলেও বর্তমানে টিকা ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতার কথা উঠে আসছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে করোনার টিকা আসার একটি প্রবাহ চলছে। বর্তমান সরকার যে প্রথম থেকেই টিকা কেনার ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটা ছিল দারুণ একটি উদ্যোগ, যা সময়োচিত। করোনার যে টিকাগুলো এখন আমরা পাচ্ছি এর মধ্যে কিছু টিকা আসছে সরকারের টাকায়। আবার বৈশ্বিক টিকা কর্মসূচি কো-ভ্যাক্সের আওতায়ও কিছু আসছে। গত সপ্তাহে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার ৩০ লাখ ডোজ। এ নিয়ে এই টিকা দেশে এসেছে ৫৫ লাখ ডোজ। আর চীনের সিনোফার্মের টিকা এসেছে ৫১ লাখ ডোজ। যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজারের এসেছে ১ লাখ ডোজ। খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, আগামী মাসে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২৯ লাখ, সিনোফার্মের ৪০ লাখ, জনসন অ্যান্ড জনসনের ৬০ লাখ ডোজ আসবে। এ থেকে বোঝা যায়, করোনার টিকার ব্যাপারে সরকারের তৎপরতাও কম নয়। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল টিকা দান আর সংরক্ষণে ব্যবস্থাপনায়।
আমরা দেখেছি, আমাদের দেশে প্রথম যখন করোনার টিকা আসল, তখন তা নিয়ে কিছু মানুষ নানা ধরনের কথা তুললো। সাধারণ মানুষ সেগুলো কিছু আমলে নিল। তবে বেশিরভাগ জনসাধারণ তা আমলে নেয়নি। এরপর করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু হয়। সরকার বিনামূল্যে তা দেওয়ার সব আয়োজন করে। কিন্তু কেন যেন করোনা টিকার নিবন্ধনে আগ্রহীর সংখ্যা তখন খুব বেশি ছিল না। টিকা নিয়ে নানা টিপ্পনি চলে। এরপর মানুষকে সেই টিকা নিতে আগ্রহী করতে কার্যক্রম শুরু হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোও নানা রকম উদ্যোগ নেয়। আস্তে আস্তে জন সাধারণের আগ্রহ বাড়তে থাকে।
সাধারণ মানুষের টিকা নিয়ে আগ্রহী না হওয়ার নানা কারণ আছে। আমার মনে হয়, প্রথম দিকে মানুষ কিছুটা দ্বিধায় ছিল। অনেকে ভয় পেত। আমার মাকে কয়েক বার টিকা নিতে বললেও তিনি টিকা নেননি। আমার অনেক বন্ধুর বাবা-মাও টিকা নিতে চাচ্ছেন না বলে শুনেছি। তারা সম্ভবত ভয় পাচ্ছিলেন। করোনার টিকা নিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হয়, না হয়। কারণ টিকাটা একেবারে নতুন। আবার এর মধ্যে দেশে বিদেশে দুই এক টিকা দেওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেছেন বলে কোনো কোনো মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়। এসব থেকে অনেকের মনেই ভয় ঢুকে যায়। তারা বুঝতে পারছিলেন না, টিকা নিবেন নাকি নিবেন না। কথা ভাবছিল। এরপর যখন মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি সবাই টিকা নেওয়া শুরু করলেন এবং টিকা নিয়ে তাদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিল না, তখন অনেকে স্বস্তি পেলেন। এভাবে মানুষের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিছুটা কেটে যেতে লাগলো। মানুষ বুঝতে পারলো, টিকা ছাড়া শুধু সাধারণ চিকিৎসায় করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচা সহজ নয়। আর করোনাভাইরাস নির্মূল করতে টিকার বিকল্প নেই।
মানুষ যখন করোনার টিকা গ্রহণে আগ্রহী হল, এক পর্যায়ে টিকার সংকট দেখা দেয়। সেই সংকটে সরকার অনেক উদ্যোগী হয়ে উঠে। এর ফল এখন পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখছি, বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে আবারও করোনার টিকা আসতে শুরু করেছে। আর আমাদের জন সাধারণ করোনার এই টিকা গ্রহণ করতে চাচ্ছে। তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ বেশ কিছুদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু খারাপ লাগলো এটা জেনে, চলতি মাসে দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম শুরু হলেও টিকা নিয়ে নানা পর্যায়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম ঝামেলাটি হয়েছে টিকার নিবন্ধন নিয়ে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত টিকার নিবন্ধন করেছেন প্রায় ১১ কোটি। এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ নিতে পেরেছেন ৭১ লাখ ৮৯ হাজার ৩শ ৩৪ জন। দ্বিতীয় ডোজ নিতে পেরেছেন ৪৩ লাখ ১ হাজার ৪শ ৫ জন।
পত্রিকা পড়ে জেনেছি, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা টিকা পেতে নানা ভোগান্তিতে পড়ছেন। যারা সাধারণ মানুষ তাদের অনেকে আবার নিবন্ধন করতে পারছেন না। আর নিবন্ধন করলেও এসএমএস পাচ্ছেন না। কিংবা এসএমএস পেলেও হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে টিকা নাই, শেষ হয়ে গেছে। দেশে এমন আরও কত মানুষ টিকা নিতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে, তা অনুসন্ধান করে তালিকা করা দরকার। এসব সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সরকারের টিকা কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়া স্বাভাবিক। আর প্রবাসী শ্রমিকদের সময় খুব মূল্যবান। তারা যদি সময়মতো টিকা নিতে না পারেন তাহলে তাদের অনেক ঝামেলার মুখে পড়তে হতে পারে। সেই ঝামেলার কারণে অনেক ভোগান্তিতে পড়বে প্রবাসীরা। তাই সবদিক বিবেচনা করে প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্ভোগ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি। টিকা নিবন্ধনের এই রকম পরিস্থিতিতে আমরা একটি খবরে খুশি হয়েছি। আমরা জেনেছি, টিকা গ্রহণের বয়স ত্রিশে কমিয়ে আনা হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পর্যায়ক্রমে দেশের সবাইকে করোনার টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
আরেকটি ব্যাপারে কারো কারো মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। বিষয়টি হল করোনার টিকার সংরক্ষণ। বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন নিজে শংকা প্রকাশ করেছেন তখন এ বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। জানতে পেরেছি, অ্যাস্ট্রাজেনিকা ও সিনোফার্মের টিকা সংরক্ষণের তাপমাত্রা ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মডার্নার ক্ষেত্রে মাইনাস ১৫ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফাইজারের ক্ষেত্রে মাইনাস ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে করোনার টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা দাবি করেছেন, এই তাপমাত্রা সক্ষমতা ও জায়গা যথেষ্ট রয়েছে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কড়া দৃষ্টি আশা করছি।
সরকার যেভাবে এত বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে নানা কৌশল এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে সব সামাল দিচ্ছে, তাতে সংশ্লিষ্ট সকলেই প্রশংসার দাবীদার। আমরা দেখেছি করোনার সোয়াব টেস্টের জন্য কিছু ভুয়া ক্লিনিক গজিয়ে উঠেছিল গত বছর। লাখ লাখ টাকা নিয়ে মানুষকে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছে তারা। সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে একটা বার্তা দিয়েছে যে এ ধরনের অপকর্মের শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমরা দেখেছি, সরকার টিকার ব্যাপারে বেসরকারি ভুয়া ক্লিনিকের কারসাজি বন্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা নিয়েছে। এখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় টিকার ব্যবস্থায় যেন কোনো চক্র ঢুকে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়।
আর একটি কথা না বললেই নয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু এটাও খেয়াল রাখতে হবে দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক মানুষ এক্ষেত্রে কিন্তু পিছিয়ে পড়ছে। করোনার টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটি যদি প্রথম পর্যায়ের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা না করে, তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হতে পারে। তাই সব দিক চিন্তা করে আগামী পরিকল্পনা করা হোক, আমাদের প্রত্যাশা সেটাই।
প্রকাশিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক নতুন বার্তা, ২৪ জুলাই, ২০২১