করোনায় বেকারত্বের সংকট দীর্ঘায়িত যেন না হয়

হাসান হামিদ

আমাদের দেশের তরুণেরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় এ দেশের একজন স্বপ্নবান তরুণ শিক্ষার্থী তার পরিবার ও দেশ নিয়ে যেমন ভাবেন, যেভাবে স্বপ্ন দেখেন; বিশ্বের আর কোনো দেশের তরুণরা এতো আবেগ নিয়ে এমন করে আর ভাবেন বলে আমার জানা নেই। তরুণদের তীব্র দেশপ্রেমের ফসলই আমাদের আজকের এই বাংলাদেশ। আমি জানি, এই দেশের তরুণরা অচেনা অজানা মানুষের জীবন বাঁচাতে দল বেঁধে রক্ত দান করেন। সব সময় দেখি, নানা ভাবে আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে কোনো সমস্যায় সবার পাশে এসে দাঁড়ান। জাতীয় এবং স্থানীয় দুর্যোগে এর শত শত উদাহরণ আমরা দেখেছি। অথচ দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই তরুণরাই পড়াশোনা শেষে একসময় কাজ না পেয়ে হতাশ হন। তাদের প্রচণ্ড আগ্রহ আছে কাজ করার, সুযোগ নেই। করোনাকালে এর মধ্যে অন্য সবকিছুর সাথে থমকে গেছে চাকরির পরীক্ষাগুলো। স্থগিত হওয়া সেইসব পরীক্ষা নিয়ে আমি যেন কিছু লিখি, সে কথা জানিয়ে আমার কাছে মেসেঞ্জারে ইনবক্সে গত এক মাসে অন্তত পাঁচ শতাধিক চাকরিপ্রার্থী অনুরোধ জানিয়েছেন। তাদের কয়েক জনের সাথে আমার কথাও হয়েছে। ভয়াবহ এক দুশ্চিন্তায় কাটছে তাদের দিন। সামনের দিনে কী হবে তারা কেউ জানেন না।

আমাদের এই যে চাকরি পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারটি কি শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক? এর সঙ্গে কি রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক আছে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কি নাগরিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার কথা থাকে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাশকাটিয়ে আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিচ্ছি, একজন নাগরিকের চাকরি পাওয়া না পাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা নেই। সরকারি চাকরি সবাই পাবেন না, সেটা সম্ভবও নয়, কিন্তু কোনো না কোনো কাজ তো পেতে হবে। সেই বেসরকারি খাত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকার ব্যাপার রয়েছে। আর সক্ষম মানুষেরা যেন কোনো একটা কাজ পান, তা নিশ্চিত করা কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পিরিয়ে আসা কাজহীন একজন স্বপ্নবান তরুণ তার পরিবারের কাছে দাঁড়াতে পারেন না। তার নির্ঘুম রাত কাটে। আর পুরো এই চক্রটির জন্য দায়ী আমাদের ভুল সামাজিক মাপকাঠির কারণে সৃষ্ট চাকরির নির্দিষ্ট দিকে তরুণদের ঝোঁক, যুগের উপযোগী নয় এমন শিক্ষাব্যবস্থা, উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, বাস্তবসম্মত শিক্ষা কারিকুলাম ও পরিকল্পনা গ্রহণের অক্ষমতা এসব। আমার বিশ্বাস এ দেশের প্রত্যেকটি তরুণ নির্মাণ করতে চায় উন্নত ও সুখি এক বাংলাদেশ।

করোনাকালের চলমান সংকটে চাকরির বাজার নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালীন সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে আমাদের দেশের কথাও আছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে। আর গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই এই বেকারত্ব বাড়ছে। আইএলও আরও বলেছে, করোনার কারণে সৃষ্ট মহামারিতে বেকার তরুণরা তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। একদিকে তারা বেকার, সেই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও ব্যাহত হচ্ছে তাদের। এতে তাদের চাকরিতে প্রবেশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে।

আইএলও এর হিসাবে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। যদিও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সংখ্যা বাস্তবে আসলে অনেক বেশি। আমাদের দেশে বেকার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তরুণদের একটা বড় অংশ হতাশায় ডুবছে, অথচ তারা কাজ পেলে কাজ করবে। তাদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না। দিনের পর দিন কেন তারা বেকার থাকছে? পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের চাকরির বাজারে যোগদান করে। এদের বড় একটি সংখ্যক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা করেন। আমরা জানি এমনিতেই এদেশে বেকারত্বের হার অনেক। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে সেই সংকট আরো অনেকখানি বেড়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ আর ২৭ লাখ বেকার। তবে জরিপেই বলা আছে, পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ। এছাড়া আছে আরও ১ কোটি ৬ লাখ দিনমজুর, যাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর সম্ভাবনাময় কিন্তু সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পান না এরকম ব্যক্তি (লেবার আন্ডার ইউটিলাইজেশন), যাদের ছদ্ম-বেকার বলা হয়, এরকম মানুষ রয়েছেন প্রায় ৬৬ লাখ। এরা চাহিদা মাফিক কাজ না পেয়ে টিউশনি, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয় কর্মী এসব খণ্ডকালীন কাজ করেন।

এবার আমাদের দেশের চাকরি প্রার্থী তরুণদের বর্তমান উদ্বিগ্নতার কারণ কী সেটা বলি। সেটা হলো, বর্তমানে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রায় নেই। সরকারি কিংবা বেসরকারি। আমাদের দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম মহামারি করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমন রোধে মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন এই চার মাসে সরকারি চাকরির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে কারণে আটকে গেছে তিনটি বিসিএস ও নন ক্যাডার চাকরির পরীক্ষাসহ পাবলিক সার্ভিস কমিশন-পিএসসির ১৩টি পরীক্ষা। সরকারি কর্ম কমিশন বলছে, যেসব বিসিএসের ফল ও পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে, তা করোনাভাইরাসের কারণে। পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সরকারি চাকরির অন্যতম বড় খাত ব্যাংক। এ খাতের নিয়োগ পরীক্ষাও আটকে আছে। নতুন করে কোনো নিয়োগ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পায়নি। জনতা ব্যাংকের অফিসার পদের একটি মৌখিক পরীক্ষা করোনার জন্য মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আর একটির প্রিলিমিনারি পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। আরও অনেক নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত আছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন সেন্টারের (ব্যান্সডক) প্রথম শ্রেণির সায়েন্টিফিক অফিসার ও অ্যাকাউন্টস অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষা। এটি গত ২০ মার্চ নির্ধারিত ছিল। ৩৫ পদের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৫০ হাজার। একই দিনে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ১১ ক্যাটাগরির পদে মোট ৪৫ পদের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৩৫ হাজার এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগের স্বাস্থ্য পরীক্ষাও স্থগিত আছে। খাদ্য অধিদপ্তরের ১ হাজার ১০০ পদের আবেদনকারী ছিলেন ১৫ লাখ। মার্চ-এপ্রিলে এ পরীক্ষা নেওয়ার চিন্তা ছিল। এ পরীক্ষাও নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

দুদকের বিভিন্ন পদের পরীক্ষাও আটকে আছে। করোনার প্রকোপ রোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালকের ১৩২টি ও উপ-সহকারী পরিচালকের ১৪৭টি শূন্যপদের মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। যদিও এর মধ্যে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে উপসহকারী পরিচালক পদে মৌখিক পরীক্ষা শুরু করা হয়েছিল। অন্যদিকে ২১ মার্চ থেকে সহকারী পরিচালক পদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হওয়া কথা ছিল। করোনো ভাইরোসের প্রকোপ ঠেকাতে পরীক্ষা সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এই পরীক্ষাগুলোর সাথে অনেকের স্বপ্ন ও জীবন জড়িত। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই পরীক্ষাগুলো কোনো ভাবে নেওয়া যায় কিনা সেটা নিয়ে আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখা যায়। যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষাগুলো নিলে তাদের বেকারত্ব দীর্ঘায়িত হতো না।

বেকারত্ব দীর্ঘায়িত হবার আরেকটি কারণ আমাদের দেশে আছে। সেটি হলো কয়েক দশক ধরে অজানা এক কারণে এদেশে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে বিশেষায়িত ও কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব কম ছিল। আর বাংলাদেশে বেশিরভাগ উচ্চশিক্ষিতের সরকারি চাকরি বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছে। বিসিএস উন্মাদনা নিয়ে কিছুদিন আগে বিবিসি পর্যন্ত রিপোর্ট করেছে। এই বিসিএস উন্মাদনা তৈরি হয়েছে কারণ আমাদের দেশে যে শ্রেণিটি চাকরির জন্য প্রার্থী হয়, তাদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত বা এর পরের শ্রেণির সদস্য। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণ একজন শিক্ষার্থী তার পরিবারের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা আগে ভাববে সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারি চাকরির পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট করার কারণে বেড়ে যাওয়া শিক্ষিত বেকারের হার দেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি খাতের ভালো চাকরি পেতে অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতার দরকার হয়। সে তুলনায় সরকারি চাকরিতে কোনো দক্ষতা লাগে না। নির্দিষ্ট ছকে বাধা কিছু পড়াশোনা করে সেই চাকরি লাভ করা গেলেও সুযোগ কম থাকায় অল্প সংখ্যক এখানে যোগ দিতে পারেন। বাকিরা থেকে যান বেকার। তারা বেসরকারি ভালো চাকরিতেও সুযোগ পান না। এর অর্থ, চাকরির বাজারে যে ধরনের দক্ষতা ও যোগ্যতা দরকার, সে ধরনের শিক্ষা তারা পাচ্ছেন না।

বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক হয়েও বাংলাদেশে অনেকে জনপ্রশাসনের চাকরিতে গেছেন। ইকোনমিস্ট বলছে, শিক্ষা পরিকল্পনায় গলদের কারণে এটা হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা নিজের আগ্রহ ও পছন্দের বিষয়ে পড়তে পারেন না। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যে বিষয়ে সুযোগ পান, সেটা পড়তে বাধ্য হন। আর চাকরির ক্ষেত্রে যে সুযোগ আসে সেখানেই যোগ দিতে চান। এর মধ্যে পড়াশোনার পাশাপাশি কেউ কেউ নিজেদের কারিগরি যোগ্যতা ও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশির ভাগই এ কাজটি করেন না। চাকরির বাজারে তারাই এগিয়ে যান, যারা নিজেদের বিশেষায়িত যোগ্যতা বাড়িয়ে নেন। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে মনে করে ইকোনমিস্ট। দুঃখজনক হলেও সত্য যে,  আমাদের নীতিনির্ধারকেরা জানেন না, শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোন খাতে কত শিক্ষার্থী প্রয়োজন।

অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে, আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে বাস্তবতার অনেক অসামঞ্জস্য রয়েছে। দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তাই তাদের প্রতিষ্ঠানে অনেক খাতে যোগ্য লোক বিদেশ থেকে আনেন। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটায় অর্থহীন অনেক বিষয়ে পড়াশোনা করে। চাকরির জন্য যেভাবে তারা নিজেদের তৈরি করে, সেটি মোটেই যুগোপযোগী নয়। চাকরির ত্রুটি পূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষা নিয়েও কেউ কিছু ভাবেন না। উন্নত দেশে কী হচ্ছে সে খবর সবাই জানেন, কিন্তু এখানকার তরুণদের সেভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে না। অযথা অনেক আগে থেকে চালু হওয়া ভুল শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের অদক্ষ করছে। আর তার মাশুল দিতে হচ্ছে তরুণদের।

প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ০৫ আগস্ট, ২০২০

করোনায় বেকারত্বের সংকট দীর্ঘায়িত যেন না হয়
Scroll to top