হাসান হামিদ
বার্লিন প্রবাসী বাংলাদেশের নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার করোনাকালে ছোট ছোট কিছু কবিতা লিখেছেন। এর কয়েকটি আমি পড়েছি। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন,
‘‘বলো হে ঈশ্বরী পাটনী, কীভাবে তোমার সন্তান
বাঁচবে দুধেভাতে মুমূর্ষু বিশ্বদেশে?
যেদিকে তাকাই তীক্ষ্ণ মৃত্যুবাণ।
বাঁচার সমস্ত পথ রুদ্ধ, বাঁচাও দুঃসহ বদ্ধ পরিবেশে।
জীবন নিমেষে উধাও, বাতাস বিষমাখা
খাদ্যাভাব ঘরে ঘরে, দূষিত পানীয়
জলের অতলে ক্রন্দন, মানুষ দিশেহারা। আমার পতাকা
বহনের কেউ থাকবে না, হে স্বজন, প্রিয়?”
সমস্ত পৃথিবীতে মানুষের এখন একটিই প্রশ্ন, করোনাকাল কবে নাগাদ শেষ হবে? জলের অতলে যে ক্রন্দন, তার থেমে যাওয়ার দৃশ্যপটের অপেক্ষায় সবাই। কয়েক দিন ধরে অফিসে যাওয়া আসার পথে একটা সাধারণ দৃশ্য খুব ঘনঘন আমার চোখে পড়ছে। সেটি হলো একটি পিকআপে একটা সংসার তুলে দিয়ে আড়ালে চোখ মুছছেন গৃহকর্তা। কয়েক দশকের তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসারটিকে দুমড়ে যাওয়ায় তারা ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। ঢাকায় এখন টু-লেটের ছড়াছড়ি। এর আগে বাসাভাড়ার এত বিজ্ঞাপন দেখেনি এ শহরের মানুষ। খবরের কাগজেও আমরা পড়েছি, ছবি দেখেছি; লাখ লাখ মানুষ ছেড়ে যাচ্ছে ঢাকা। এদের দু একজনের সাথে আমি সাহস করে কথা বলেছি। বিস্মিত হয়েছি এটা ভেবে, বর্তমানকে সংকটে রেখে তবু মানুষ আগামীর স্বপ্নের কথা ভাবতে পারে। তবু সবার ঘুরে ফিরে প্রশ্ন একটাই, কবে আবার সব ঠিক হবে? নিউ-নরমালের জন্য অধীর অপেক্ষা করছে মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতি, সংকটপূর্ণ সমাজ, অস্থির দেশ অথবা পুরো বিশ্ব। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এই সময়েও বাংলাদেশে দল বেঁধে ধর্ষ লণের মতো ঘটনা ঘটছে, খুনাখুনি হচ্ছে; দুর্নীতির কথা না-ই বললাম। করোনা টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক কিছুই বের হচ্ছে। কেঁচো খুড়তে সাপ নয়, পাওয়া যাচ্ছে সাপের খামার।
আমরা জানি, ২০০৭-০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ছিল। সেটি কাটিয়ে ওঠার জন্য করণীয় পলিসি নির্ধারণে অর্থনীতিবিদরা নিউ-নরমাল প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। উন্নয়ন শাস্ত্রে নিউ-নরমাল বলতে মানুষের আচরণগত পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, যে আচরণ পূর্বে অস্বাভাবিক ছিল পরবর্তী অবস্থায় তা স্বাভাবিক হিসেবেই পরিচিত হয়।
এখন করোনাকাল চলছে। আর করোনাকে কেন্দ্র করে নিউ নরমাল প্রত্যয়টি পুনরায় আলোচিত হচ্ছে। আমরা এখন পর্যন্ত প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে বলতে পারি, করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যদিও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ফার্মা প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল চলছে। আর মানুষের ওপর চলমান প্রাথমিক পর্যায়ের এই ট্রায়ালের ফলাফল ২০ জুলাই প্রকাশিত হবে বলা হয়েছে। আর মানুষের ওপর চলমান এই পরীক্ষা শেষে বোঝা যাবে এই ভ্যাকসিন করোনা থেকে মানুষকে সুরক্ষিত করতে সক্ষম কিনা। তবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান দু’টি এখনও প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষার ফলাফ প্রকাশ করেনি। ওই পরীক্ষা থেকে বোঝা যাওয়ার কথা এই ভ্যাকসিন নিরাপদ কিনা, আর এ থেকে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠে কিনা। সে যাই হোক, করোনা আরও দীর্ঘ সময় থাকবে এটা মনে করে এবং এই প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির চাকাকে সচল করার উদ্দেশ্যে লকডাউন তুলে দিয়েছে অনেক দেশ। পাশাপাশি নতুন কিছু আচরণে অভ্যস্ত হয়ে কাজে যোগদানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশই এই পলিসি গ্রহণ করেছে। আমাদের বাংলাদেশ সরকারও ইতিমধ্যে এ ধরনের ঘোষণা দিয়েছে।
করোনার এমন অবস্থায় তৈরি হওয়া নিউ নরমাল আচরণ সম্পর্কে বলার আগে কিছু পরিস্থিতি তুলে ধরা দরকার। আমরা দেখছি, এর মধ্যে আমাদের দেশের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় অনেক কমে গেছে৷ আমরা দেখছি, মধ্যপ্রাচ্যের তেলনির্ভর দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। আর এসব দেশে থাকা আমাদের প্রবাসীরা সামনের দিনগুলোতে আরও ব্যাপকভাবে চাকরি হারাবে। ইতিমধ্যে ৬ লাখের বেশি প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছে, বিমান চলাচল চালু হলে আরও অনেকেই ফিরে আসতে বাধ্য হবে। ফিরে আশা শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থা কি হবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, বার্ষিক ১৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে এই প্রবাসী শ্রমিকরাই। এ ব্যাপারে সরকারের স্পষ্ট একটি পরিকল্পনা দরকার।
মানুষ শহর ছেড়ে যাচ্ছে। কারণ শহরের বেশিরভাগ মানুষের কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব কম-বেশি পড়তে শুরু করেছে৷ হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহণ শ্রমিক, রিকশা চালক, দিনমজুরসহ বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের কোন কাজ এখন নেই বললেই চলে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনায় লকডাউনের কারণে এক মাসে অর্থনীতিতে এক লাখ দুই হাজার তিনশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে৷ আর কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে দেশে ক্ষতির পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার তিনশ কোটি টাকা৷ আর বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই থেকে তিন শতাংশে নেমে যেতে পারে৷ যেখানে অর্থবছরের শুরুতে আট দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার৷
এবার কিছু সাম্প্রতিক গবেষণা ও পরিসংখ্যানের দিকে নজর দেব। ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ব্র্যাক গত মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছে। ৩ শতাংশ লোক চাকরি থাকলেও বেতন পায়নি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ। বলা হয়েছে, ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি আর লকডাউনে প্রায় ৫ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। ব্র্যাক এর প্রতিবেদন আরও বলছে, এই সময়ে ৯৩ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। সেই কমাটা কতটুকু তা হয়তো জানা যাবে না। কিন্তু এর ফলে বাস্তবে কী ঘটছে তা লক্ষ করলে আন্দাজ করা যায়, মানুষ কোন পর্যায়ে সংসার পিকআপে তুলে দিয়ে চোখ মুছে।
খবরের কাগজের তথ্য থেকে জানতে পেরেছি, করোনার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬৪ হাজার পোশাকশ্রমিক চাকরি হারিয়েছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই চলছে শ্রমিক ছাঁটাই। জুলাই মাসের শুরুতে দেখলাম, সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ২৫ হাজার শ্রমিক তাদের দীর্ঘদিনের চাকরি হারিয়েছেন।
বিআইডিএসের করা গবেষণা জরিপের তথ্য আরও সুস্পষ্ট। তাদের করা এক জরিপে অংশ নেওয়া ১৩ শতাংশ চাকরি হারিয়েছেন। এদের মধ্যে যাদের আয় ১১ হাজার টাকার কম, তাদের ৫৬ দশমিক ৯০ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। আর ৩২ দশমিক ১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। আবার, যাদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে, তাদের ২৩ দশমিক ২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আর ৪৭ দশমিক ২৭ শতাংশের আয় কমে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের দেশে এই সময়ে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।
আবার অনেকের চাকরি থাকলেও গত কয়েক মাস হয়তো অর্ধেক বেতন পাচ্ছেন, বা কেউ পাচ্ছেনই না। আর এমন লোকের সংখ্যা এখন দিন দিন বাড়ছে। তারা শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকে আছেন, যারা কষ্ট করে এতদিন টিকে থাকলেও এখন ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন। আর সে কারণে ঢাকার বাড়িওয়ালারাও পড়েছেন লোকসানের মুখে। অনেকে দিনের পর দিন টু-লেট লাগিয়েও ভাড়াটিয়া পাচ্ছেন না। কোনো কোনো বাড়িওয়ালা ভাড়া কমিয়ে দেওয়ার পরও ভাড়াটিয়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর যারা ঢাকায় থেকে যাচ্ছেন তারাও কেউ কেউ অভিজাত এলাকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় যেখানে বাড়ি পাওয়া যায় সেখানে চলে যাচ্ছেন।
করোনা বাস্তবতায় তৈরি হওয়া নিউ নরমাল আচরণে সবসময় মুখে মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, যতটা সম্ভব ঘরে থাকা, ঘরে থেকে কাজ করা, হ্যান্ড-গ্লাভস বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, ডিজিটাল মাধ্যম বা অনলাইনের মাধ্যমে কাজ করা এবং পাঠদান ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধরনের পরামর্শ পালন বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ? ক্ষেত্রবিশেষে চাকরিজীবি যাদের অফিস অবকাঠামোর সঙ্গে অনলাইন নেটওয়ার্ক আছে তাদের বাস্তবতায় এসব সম্ভব। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ, বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশাচালক, হকার, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের কাছে তার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। তাছাড়া নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানদের কাছে অনলাইনে শিক্ষার অভ্যস্ততা তো দূরের কথা, সেজন্য যে ব্যবস্থা দরকার তাও নেই বা থাকার কথা নয়। এসব অনুশীলন যেমন নিম্ন আয়ের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই নয়, তেমনি আচরণগুলোও তাদের পক্ষে মেনে চলা কঠিন। আর আমাদের দেশে শ্রমজীবীদের জীবন গত চার মাস ধরে কীভাবে কেটেছে তার বর্ণনা দেওয়া সহজ নয়। করোনাকালে তাদের কর্মহীনতায় সহায়তা করার জন্য ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। তারা কতটুকু সহায়তা পেয়েছে তার হিসাব বের করা কঠিন। করোনা এদের নিম্নবিত্ত থেকে দরিদ্রের কাতারে নামিয়ে এনেছে। সামনে আর কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে কে জানে!
প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক মানবকণ্ঠ, ১৯ জুলাই, ২০২০