করোনায় দীর্ঘায়িত যেন না হয় বেকারত্বের সংকট

হাসান হামিদ

বিশ্বজুড়ে চলছে করোনার সংক্রমণ। কোনো কোনো দেশে চলছে লকডাউন। দীর্ঘ লোকসান আর বইতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। খরচ কমাতে নিরুপায় হয়ে সেখানে চলছে কর্মী ছাঁটাই। বেকার হচ্ছে মানুষ। করোনার দাপটে নানা বিধি-নিষেধে অন্য কাজও যে করবে কর্ম হারানো মানুষগুলো, সেই সুযোগ নেই। চারদিকে পরিস্থিতি বদলে গেছে চাকরির বাজারের। আগের অনেক স্বাভাবিক চিত্র এখন রীতিমতো কল্পনাতীত। আর আমাদের ছোট্ট এই বাংলাদেশে এমনিতেই চাকরি পাওয়াকে ‘সোনার হরিণ’ হাতে পাওয়া বলা হয়। এখন করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে সংকুচিত হয়েছে দেশের বেশিরভাগ চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা। তাতে কাজ হারিয়েছেন অনেকে। এই নতুন বেকারদের পরিসংখ্যান দিন দিন বাড়ছে। কেউ কেউ এদের বলছেন ‘নতুন গরিব’। এই নতুন গরিবদের তালিকায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে আরও মানুষ। জীবন যেভাবে চলছিল তা থেমে গেছে, বদলে গেছে যাপনের যাবতীয় রূপ। আবার কবে নাগাদ স্বাভাবিক অবস্থায় সব ফিরবে, কেউ তা বলতে পারবে না।

করোনাভাইরাস নিয়ে যারা গবেষণা করছেন, তাদের আশঙ্কা হলো এই মহামারির কারণে আর্থিক মন্দা বহাল থাকবে আরো কয়েক বছর। আর এর প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়বে। যখন ব্যবসা হবে না, তখন প্রভাবটি গড়াবে চাকরির বাজারে। নতুন ছাঁটাই হওয়া কর্মী বেকারদের তালিকা ভারী করবে। আবার ব্যবসা না হওয়ায় নিয়োগ বন্ধ থাকায় এই বেকারত্ব কত দিন ধরে চলবে তা আন্দাজ করা কঠিন। হতাশ বেকার জনগোষ্ঠী সংকটে যেন না পড়ে বা এই সংকট যেন দীর্ঘায়িত না হয় তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে। আর বাংলাদেশের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছে (সাতাশ দশমিক ঊনচল্লিশ শতাংশ)। আইএলও বলছে, মহামারিতে বেকার তরুণেরা তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে বেকার, সেই সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও ব্যাহত হচ্ছে। এতে তাদের চাকরিতে প্রবেশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। তাদের প্রতিবেদনে আরও বলেছে যে, করোনা সংক্রমণ বাড়ার কারণে এই বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে আগামী তিন মাসের মধ্যে সাড়ে উনিশ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের পূর্ণ বা খণ্ডকালীন মোট কর্মশক্তির প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনের পেশা কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ক্ষতির শিকার বড় একটি অংশ তরুণ-তরুণীরা।

গত দেড় বছরে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, দেশে করোনায় চাকরির সুযোগ কমে যাচ্ছে। নিয়োগদাতারা এখন আর নতুন কর্মীর সন্ধান তেমন একটা করছেন না বলেই মনে হয়। করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চাকরি খোঁজার পোর্টালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। প্রতিবেদনে তারা বলছে, অনলাইন পোর্টালটিতে আগের বছরের এপ্রিলের তুলনায় সাতাশি শতাংশ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমেছে। এর মানে হলো, নতুন চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ একদিকে বন্ধ, অন্যদিকে প্রকাশিত চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে অনেকে আবেদন করে বসে আছেন, কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে না। এর মধ্যে আবার কারো কারো হয়তো চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, চাকরির বাজারের এই ভয়াবহ সংকট নিয়ে প্রশাসনিক উদ্যোগ এখনও নেওয়া হচ্ছে না। তাতে তরুণদের হতাশা আরও বাড়ছে।

শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী আছে ছয় কোটি পয়ত্রিশ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ছয় কোটি আট লাখ নারী-পুরুষ আর সাতাশ লাখ বেকার। আর সম্ভাবনাময় কিন্তু সপ্তাহে চল্লিশ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পান না এরকম ব্যক্তি (লেবার আন্ডার ইউটিলাইজেশন) যাদের ছদ্ম-বেকার বর্ণনা করা হয়, এরকম মানুষ রয়েছেন প্রায় ছেষট্টি লাখ। এরা চাহিদা মাফিক কাজ না পেয়ে টিউশনি, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয় কর্মী ইত্যাদি খণ্ডকালীন কাজ করেন। আমাদের দেশে বেকারত্বের হার চার দশমিক দুই শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার এখন এগারো দশমিক ছয় শতাংশ। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সর্বশেষ গবেষণা বলছে, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার তেত্রিশ দশমিক বত্রিশ শতাংশ। প্রত্যেক বছর গেল বছরের চেয়ে আরো বেশি চাকরিপ্রত্যাশী বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্র ও পদসংখ্যা সীমিত। এ কারণে চাকরি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে অনেককেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের পাঁচ কোটি সতেরো লাখ শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত রয়েছে। যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের পঁচাশি ভাগ। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হওয়ায় এই বিপুল পরিমাণ মানুষ রয়েছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। বিবিএসের হিসেবে ২০১৯ সাল শেষে বাংলাদেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে বিশ শতাংশ। সম্প্রতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম এক গবেষণায় বলেছে, যদি পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকে সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আয় পঁচিশ ভাগ কমে গেলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরো বিশ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।

কেবল আমাদের দেশে নয়, করোনার প্রভাবে সারা বিশ্বেই বেকারত্ব বাড়ছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার চৌদ্দ দশমিক সাত শতাংশে পৌঁছেছে। শুধু গত বছরের এপ্রিল মাসে দুই কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে দেশটিতে। ঠিক একই অবস্থা ইউরোপের দেশগুলোতেও। কঠিন সময়ে মানুষের চাকরি ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, বর্তমানে বিশ্বের তিনশো ত্রিশ কোটি কর্মজীবী মানুষের মধ্যে একাশি শতাংশই ক্ষতির মুখে পড়েছেন। বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কারখানা পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ হিসেবে বিশ্বের পাঁচ জন কর্মজীবীর চার জনই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। করোনাভাইরাসে বিশ্বের কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা বলছে আইএলও। তারা বলেছে, করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও শ্রম সংকটে বিশ্বে আরও কয়েক কোটি বেকার বাড়বে। সব দেশেই নতুন চাকরি তো নেই, যারা ছিল, এখন তাদের অনেককে ছাঁটাই করা হচ্ছে। আর যতদিন পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক না হবে, ততদিন ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের শ্রমবাজারে প্রবেশ করাটা বেশ কঠিন।

চাকরিপ্রার্থীদের বলবো, করোনার এই সময়ে এবং এ অবস্থার পরবর্তী সময়ে চাকরি পাওয়ার লড়াই সহজ হবে না। তাই নিজেকে অন্যের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য প্রমাণ করতে এবং নিজের দক্ষতা বাড়াতে পরিশ্রম করতে হবে। নিজেকে তৈরি করতে হবে আগামীর পৃথিবীর জন্য।

করোনায় দীর্ঘায়িত যেন না হয় বেকারত্বের সংকট

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top