করোনাকালীন ডেঙ্গু : গোদের উপর বিষফোড়া

হাসান হামিদ

ডেঙ্গু নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে আমাদের মনে ভয়ানক ভয় ঢুকেছে। এই ভয়ের যথার্থ কারণও আছে। আমি যে অফিসে কাজ করতাম, সেখানে আমাদের এক সিনিয়র কলিগ রীতিমতো একটা ছোট চার্জার ফ্যান তার টেবিলের নিচে সার্বক্ষণিক চালুর ব্যবস্থা করেছিলেন! ডেঙ্গু এভাবেই আমাদের কাছে এক আতঙ্ক হয়ে গেছে। এখন করোনাকাল চলছে। এর মধ্যে পত্রিকায় দেখলাম, দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা জানি, গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ তেমন ছিল না। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, ২০১৯ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে এ বছরের ডেঙ্গু সংক্রমণের হারের মিল লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০১৯ সালের মে মাসে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৯৩ জন। পরের মাসেই রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে এক হাজার ৮৮৪ জনে দাঁড়িয়েছিল। এরপর জুলাইতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে ১৬ হাজার ২৫৩ হয়েছিল। সে বছর মোট এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যা এক বছরে সর্বোচ্চ সংক্রমণ। চলতি বছরের মে মাসে ৪৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী জুনে এই সংখ্যা বেড়ে ২২৫ জনে দাঁড়িয়েছিল। এখন পর্যন্ত এ বছর মোট ৫৬৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩২ জন ঢাকার বাইরের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন নতুন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। আমাদের মনে আছে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে দেশে প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর মারা গিয়েছিলেন ১৭৯ জন। তাই উদ্বেগ হচ্ছে এটা ভেবে যে, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনই সব ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। আর সেটি করোনা মহামারির কারণে ইতোমধ্যে বিপর্যস্ত হওয়া স্বাস্থ্যখাতকে আরও চাপের মুখে ঠেলে দেবে। তাতে অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

ডেঙ্গু নিয়ে কোনো আলোচনা, লেখা বা কথা শুনলে আমার মনে কিছু ভয়াবহ মূহুর্ত উঁকি দেয়। ২০১৯ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে আমার ছেলের ডেঙ্গু ধরা পড়ে। সেই রিপোর্ট যখন আমার হাতে আসে, আমি খুব দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। কারণ ঢাকায় তখন অবস্থা এমন, হাসপাতালগুলোতে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। আমার ছেলে দ্বিতীয়’র বয়স তখন দেড় বছরের কিছু বেশি। এতো ছোট মানুষ, কিছু বলতেও পারে না। রাত নটার দিকে পজিটিভ রিপোর্ট পাবার পর আমি দ্রুত পপুলার হাসপাতালে ডা. এসকে বণিকের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি তখন দেশের বাইরে। পাশাপাশি আরও কয়েকজন ডাক্তার বন্ধু ও কাছের ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করি। সবার এক কথা, হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। কারণ আমার ছেলে পানি বা তরল জাতীয় কিছু এক ফোঁটাও খায় না। আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে পাঁচ দিন যুদ্ধের পর আমার ছেলে সুস্থ হয়। আমরা বাসায় ফিরি। কিন্তু সেই সময়ে আমি কাছ থেকে মানুষের যে অসহায়ত্ব দেখেছি, আমি নিজেও যতটা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে গেছি তা ভুলার নয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কিছু মানুষের উদাসীনতা ও দুর্নীতির কারণে মশার ওষুধ ঠিকমতো না দেওয়া এবং সময় মতো প্রতিরোধের জন্য কাজ না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা চাই না, এরকম আর কখনো হোক।

আমি থাকি ঢাকা শহরের গোড়ান এলাকায়। এ বছর মশার পরিমাণ কম হলেও গত কয়েক দিন ধরে মশার আনাগোনা টের পাচ্ছি। ঢাকা সিটিতে উত্তর ও দক্ষিণ মিলে আমাদের দুইজন মেয়র। তারা মশা কমাতে ও এর বিস্তার প্রতিরোধে যে বক্তব্য দিয়েছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে, তাতে আমি ভেবেছিলাম প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় ফগার মেশিনের শব্দ শুনতে পাব। কিন্তু তা আজকাল শুনতে পাই না বলে হতাশ হয়েছি। মনে এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে ভাবছি, এবারও ডেঙ্গুর অবস্থা গত বছরের মতো ভয়াবহ হয় কিনা। এমনিতেই মার্চ থেকে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। এর সাথে ডেঙ্গু যুক্ত হলে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া হবে। আর তাতে অবস্থা যা দাঁড়াবে তা সামলানো কঠিন হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিপূর্ণ ও কার্যকর ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে।

ডেঙ্গুর পিক টাইম হচ্ছে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর। পত্রিকা পড়ে জেনেছি, এ বছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে এসে এর সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। তবে আসলে এটাতে সন্তুষ্ট থাকার কোনও কারণ নেই। কারণ এখন করোনাকাল চলছে। গত বছর ৮ মার্চ যখন দেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে ঠিক তখন থেকে আইইডিসিআরের তথ্যে ডেঙ্গু রোগী কমতে থাকে। এর অন্যতম কারণ হয়তো ডেঙ্গুর লক্ষণ জ্বর, করোনা রোগেরও লক্ষণ। মানুষের জ্বর হলে তখন তারা তেমন একটা ডেঙ্গুর পরীক্ষা করতো না। হাসপাতালগুলোও শুধু করোনা টেস্ট করে থাকতো। করোনা টেস্ট ছাড়া কেউ ডেঙ্গুর চিকিৎসা করতো না। মানুষও হাসপাতালে যেতে চায় না, হাসপাতালগুলোও তেমন একটা জ্বরের রোগী নেয়নি। মানে হলো কোভিডের জন্য তেমন পরীক্ষা হয়নি বলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কম মনে হচ্ছে।

গত কয়েক দিন ধরে ডেঙ্গু নিয়ে আবার আলোচনা হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, করোনা মহামারির সঙ্গে চলতি বর্ষা মৌসুমে রাজধানী ঢাকায় ফের মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গু। গত বছরে তুলনায় এ বছর রোগটি আরও ভয়াবহ আকারে বিস্তার করার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এখনই ডেঙ্গু প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে করোনার মতো ডেঙ্গুও প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। আর সিটি কর্পোরেশনের এই কাজের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের মনে আছে, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা প্রকল্প, উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। এজন্য কলকাতা ও সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতাও নিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে আলাদা বিভাগ চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। পত্রিকা ঘেঁটে দেখলাম, বছর পেরিয়ে গেলেও তার সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়নি।  তবে এ বছর দুই সিটি করপোরেশন মশক নিধন কাজে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে। বাড়িয়েছে এ খাতের বরাদ্দও। এর পরেও ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। কেন?

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বলছে, দুই ধরনের পরিকল্পনা দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে তারা। প্রথমত বছরব্যাপী, দ্বিতীয়ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।  দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনাটি যাচাই-বাছাই চলছে। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় ও মেয়রের নেতৃত্বে পাঁচটি সভা হয়েছে। সেখান থেকে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিদিন সকাল-বিকাল চার ঘণ্টা করে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। পাশাপাশি বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান বা চিরুনি অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে। বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ, যান, যন্ত্রপাতি ও কর্মী বাহিনী। এসব জেনে আমাদের ভালো লেগেছে। পাশাপাশি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছি।

চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই চার মাস ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের সচেতন করা এবং এডিস মশার বংশবিস্তারের স্থান নিয়ন্ত্রণ করা না হলে করোনা মহামারির মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বড় আকারে দেখা দিতে পারে।

আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এডিস মশা সবচেয়ে বেশি সৃষ্টি হয় নির্মাণাধীন এলাকাগুলোতে। দেশে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আছে। আর এ আইনে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিও বলা আছে। আমি মনে করি, নকশা পাসের সময় রাজউকেরও নির্দেশনা থাকা উচিত কোনো সাইটে যেন এডিস মশা জন্মাতে না পারে। রাজউক থেকে এটি তদারকের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সেটির বাস্তবায়ন তারা নিশ্চিত করবে। রাজউকের তদারক কর্মকর্তা কোনো সাইটে এডিস মশা পেলে শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা করবেন। শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে আইনের বাস্তবায়ন এদেশে কখনোই হবে না।

শরৎচন্দ্রের ‘বিলাসী’ গল্প মোটামুটি সবাই পড়েছি। এ গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুঞ্জয়ের এক বন্ধু, নাম ন্যাড়া। ছেলেটি পড়ালেখায় ভাল না। সেই ন্যাড়া একদিন স্থির করল, সে সন্ন্যাসী হবে। সেই অভিপ্রায়ে গিয়ে আশ্রিত হল এক সন্ন্যাসীর আশ্রমে। সেখানে সে থাকতে পারল না মশার কামড়ে। তাই সে জানাল, ‘মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হইয়া সন্ন্যাসগিরি ছাড়িয়া দিলাম।’ আবার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসে মশা দ্বারা গ্রামের মানুষ কীভাবে আক্রান্ত হতো, তার একটি বিবরণ পড়েছি। তবে আগেকার দিনে লোকজন, বিশেষত যারা গ্রামে থাকত, যাদের গোয়ালে গরু-মহিষ থাকত, তারা সন্ধ্যার আগে গোয়ালে ধোঁয়া দিয়ে রক্ষা করত প্রাণীগুলোকে। আর বাঁশঝাড় কিংবা কোনো জলাশয়ের পাশে যাদের ঘরবাড়ি ছিল, তারা নিজ গৃহে সন্ধ্যাবাতি জ্বালানোর অনেক আগে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই দিত উৎকর্ষ সন্ধের ধোঁয়া। ফলে তারা রেহাই পেত এডিস অথবা অ্যানোফিলিসের কামড় থেকে। গ্রামের লোকজন কোনো দিন জানত না এডিস ও অ্যানোফিলিসের নাম। শুধু জানত মশা কামড়ালে ম্যালেরিয়া হতে পারে। বলছিলাম, মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে যুগে যুগে লোকে নানা ব্যবস্থা নিত এবং এখনও নেয়। আর ডেঙ্গুর কারণে মশা যে আতঙ্কের সৃষ্টি করতে পারে এই বিংশ শতাব্দীতেও, তাতে মশা মারতে কামানের আয়োজন হয়তো নিকট ভবিষ্যতেই মানুষকে করতে হবে।

প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক সমকাল, ১৪ জুলাই, ২০২১

করোনাকালীন ডেঙ্গু : গোদের উপর বিষফোড়া

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top