করোনাকালীন অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা কতটা কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ?

হাসান হামিদ

চলছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বছরের একেবারে শেষদিকে এসে দেশের অর্থনীতি নিয়ে ভাবলে, এত হিসাব না করেও কিছু কথা বলে ফেলা যায়। এই করোনাকালে বলে দেওয়া যায়, গত এক বছর আর্থিক নানা খাতের সূচকে বাংলাদেশের যে প্রত্যাশা ছিল, তার সবটা পূরণ হয়নি। কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়েছে দেশ। তবু মনে প্রশ্ন জাগে, করোনায় বিপর্যস্ত আমাদের অর্থনীতি এরপরও কিছুটা কি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে? দেশের উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, বিভিন্ন আর্থিক খাত কিংবা মুদ্রাস্ফীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকে আমাদের অর্জন কম হয়েছে। তবে কিছুক্ষেত্রে এই করোনাকালেও বাংলাদেশের যে প্রাপ্তি তা সত্যি আশাবাদী হওয়ার মতোই। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাঝেই বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড করেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের উদ্যোক্তারা মোট ৪১৭ কোটি ডলার বা ৩৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছেন। অতীতে আর কোনো মাসেই এই পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়নি। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যা ছিল মাসিক হিসেবে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়। আর এটি এই বছর সেপ্টেম্বরে ছাড়িয়ে গেল!

বাংলাদেশ জিডিপিসহ অর্থনীতির সব সূচকের হিসাব করে থাকে আর্থিক বছর (জুলাই থেকে জুন) ধরে। সেই হিসাবে বিবিএস ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপি প্রাথমিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার দুই শত সাতাশ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ গত এক দশকে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। তাও এই করোনাকালে, এ কিন্তু কম কথা না।

কিছুদিন আগে ‘সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক ফোকাস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক করোনার ধাক্কা কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপ ও ভারতের পরই সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে বাংলাদেশের। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই অর্থবছরে মালদ্বীপের প্রবৃদ্ধি হবে সবচেয়ে বেশি ১১ শতাংশ। ভারতে হবে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এর পরই বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে বলে সুখবর দেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (ডব্লিউইও) প্রকাশ করেছে তাতে তারা বলেছে, করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে বাংলাদেশ বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। তারা বলছে, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে ভারতকে আবারও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১১৬ দশমিক ৪৪৪ ডলার।

অতীতের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, করোনা বিপর্যয়ের পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিক ভাবে বাড়ছিল। গত ৪ বছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৭ শতাংশের বেশি। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে নেমে আসে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এটা জানা কথা, করোনার কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে। কোনো কোনো দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কয়েকটি দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। সরকার চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। আর বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, এবার বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে।

গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অর্থনীতির সব থেকে শক্তিশালী জায়গা ছিল বৈদেশিক খাত। কিন্তু চলতি অর্থবছরে ভাটার টান পরিলক্ষিত হয়েছে প্রবাসী আয়ে। আমরা দেখেছি, গত অর্থবছরে অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় ছিল প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। করোনা মহামারির মধ্যেও বছরজুড়ে রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি প্রায় অব্যাহত ছিল। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮) ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। তথ্য বলছে, গত অর্থবছরের ১২ মাসের মধ্যে সাত মাসই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। কিন্তু চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরু থেকেই রেমিট্যান্সপ্রবাহে কমতি দেখা যায়। প্রথম মাস জুলাইয়ে আসে ১৮৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার। আগস্টে আসে ১৮১ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বরে এসেছে আরও কম, ১৭২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৫৪০ কোটি ৮০ লাখ (৫.৪০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ৬৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। 

করোনাকালে দেশের অর্থনীতি আসলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রপ্তানি আয়ের ওপর ভর করে। মহামারির মধ্যেই পণ্য রপ্তানিতে নতুন রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে দেশের ব্যবসায়ীরা প্রায় ৩৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করেছেন। অতীতে আর কোনো মাসেই এই পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়নি। আর পণ্য রপ্তানিতে এই নতুন রেকর্ড হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে তৈরি পোশাক খাত। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এই খাত থেকে ৩৪২ কোটি ডলার বা ২৯ হাজার ৭০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। আর চলতি বছর রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৩ হাজার ৮৭৬ কোটি ডলারের পণ্য।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৈরি পোশাকের পাশাপাশি হিমায়িত খাদ্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল ও রাসায়নিক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে মোট পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে। এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৯০৫ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের একই সময়ের ৮১৩ কোটি ডলারের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ বেশি। উল্লেখিত সময়ে ৫১৬ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে আলোচ্য সময়ে ৩৯০ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা সামলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। 

করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্বাভাবিকভাবেই ওষুধ, স্যানিটাইজার, টিসুসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসম্পর্কিত সামগ্রীর ব্যবহার হয় অনেক বেশি। এসব উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করছে। তবে দেশ শুধু রপ্তানি বেশি করেছে তা নয়, এর পাশাপাশি আমদানিও কিন্তু বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) আমদানির তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, সব মিলিয়ে এই দুই মাসে ১ হাজার ১৭২ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ শতাংশ বেশি। করোনা মহামারির মধ্যেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।

গত এক বছরের বিভিন্ন আর্থিক সূচকের পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মহামারির মতো অবস্থা মোকাবিলা বা প্রতিরোধে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। দেশের মেগা প্রকল্প ও সরকারি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প চলমান থাকায় রড, সিমেন্ট ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী উৎপাদন শিল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়েনি। বিদ্যুৎ-গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহেও তেমন ব্যাঘাত ঘটছে না। লেখাটির শেষে আশাবাদী হওয়ার মতো একটি গবেষণা জরিপের তথ্য জানাতে চাই। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) এক জরিপে বলা হয়েছে, ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান আকার ৩০২ বিলিয়ন, যা ২০৩৩ সালে হবে ৮৫৫ বিলিয়ন।

প্রকাশিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ১০ ডিসেম্বর ২০২১

করোনাকালীন অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা কতটা কাটিয়ে উঠছে বাংলাদেশ?

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top