ওষুধের মান ও অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিন

হাসান হামিদ

সব সময় সোজা পথে সমস্যার সমাধান করা যায় না। অসঙ্গতির মূলে কী আছে তার নিয়ন্ত্রণ দরকার হয়। এ নিয়ে লেখার শুরুতেই একটি গল্প বলা যাক। এক ভদ্রলোক অসুস্থ। তার ঘুমের প্রয়োজন, বিশ্রাম নেওয়া খুব জরুরি। কিন্তু বিশ্রাম নেওয়া হচ্ছে না। যে ডাক্তার তাকে রেস্ট নিতে বলেছিলেন, তিনি গিয়ে হাজির হলেন তার কাছে। সাথে তার স্ত্রীও গেলেন। ডাক্তার সব শুনে বললেন, আপনার স্বামীর দরকার টানা বিশ্রাম আর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। তাহলেই তিনি আবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু তিনি বিশ্রাম নিতে না পারলে তো সুস্থ হবেন না। রোগীর স্ত্রী বললেন, ডাক্তার সাহেব এর জন্যই যদি কিছু ওষুধ দিতেন, যাতে বিশ্রামটা হয়! চিকিৎসক এবার সিরিয়াস হলেন। কয়েক পাতা ঘুমের ওষুধ ভদ্রলোকের স্ত্রীর হাতে দিলেন। রোগীর স্ত্রী এবার জিজ্ঞেস করলেন, কখন কটা করে খাওয়াতে হবে ওকে? চিকিৎসক হেসে বললেন: ওষুধগুলো আপনার জন্য! আপনি রোজ একটা করে খাবেন।

বর্তমান সময়ে এমন অস্থির এক আবহাওয়া ঘরে বাইরে, লোকজন পুরোপুরি সুস্থ থাকবে সেই সুযোগ নেই। আজকাল পত্রিকায় নকল ওষুধ আর ওষুধের দাম নিয়ে খবর পড়ছি নিয়মিত। ভাবছি, সুস্থ হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে একজন হয়তো ডাক্তার দেখাল। তিনি ওষুধ লিখে দিলেন, সেই ওষুধ ফার্মেসি থেকে আনতে গিয়ে দেখা গেল, দাম দফায় দফায় বাড়ছে। আবার মনে ভয়, ওষুধ নকল নয়তো! এসব কাণ্ড চলতে থাকলে মানুষের স্বস্তিটা আসবে কোথা থেকে? ডোনাল্ড জি মিচেল বলেছেন, অসুস্থতা ঘোড়ায় চড়ে আসে কিন্তু যায় পায়ে হেঁটে। এর মানে কিনা, হুট করে অসুখ বিসুখ করলেও, হুটহাট সে বিদেয় হয় না। যেতে হয় ডাক্তারের কাছে, কত নিয়ম, কত রকমের ওষুধ! খুব ব্যস্ত মানুষটিও অসুখ করলে, চুপ হয়ে যান, চুপ হতে বাধ্য হন। ফ্রাঙ্কোয়েস সাগান এ কারণেই বলেছেন, অসুস্থতা স্বাধীনতার বিপরীত। এটি সবকিছুকে অসম্ভব করে তোলে।

আমাদের দেশে করোনার সংক্রমণ যখন শুরু হলো, বাড়তে লাগলো মৃত্যুর সংখ্যা তখন বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসীগুলোতে ওষুধ কিনতে আসা ক্রেতার ভীড় লেগে গেল। গত বছর আমরা দেখেছি, সর্দি, কাশি, জ্বরের রোগী বাড়ার সাথে সাথে দেখা দিয়েছিল প্যারাসিটামল জাতীয় ওধুষের সংকট। এ রকম আরও কিছু ওধুষের সংকট তৈরি হলে বিক্রেতারা দাম বাড়িয়ে দেন। সবাই না হলেও কেউ কেউ। পত্রিকায় এসব নিয়ে নিউজ হয়েছে। আমরা দেখেছি, ওধুষের দাম বেড়েছে বলে অভিযোগ করছেন ক্রেতারা। তবে বিক্রেতারা বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিছুদিন ধরে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমতে দেখা গেলেও ডেঙ্গু বাড়ছে। দেশের হাসপাতালগুলো করোনা নয়তো ডেঙ্গু রোগীতে পূর্ণ বলা যায়। ফলে ওষুধের চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে। আর এই সুযোগটাই নিচ্ছেন কোনো কোনো ওষুধ বিক্রেতা। পত্রিকায় পড়লাম, প্রয়োজনীয় অনেক ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ওষুধ বিক্রেতারা।

এই যে দাম বাড়লো, এর কোনো যথার্থ মনিটরিং নেই। নেই সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ। দামের সমস্যার সাথে যুক্ত হয়েছে মানের ব্যাপার। আমরা জানি, দেশের বড় ও নামকরা কোম্পানির ওষুধের দাম বেশি। কিন্তু অন্য আরেক কোম্পানি একই ওষুধ হয়তো কমদামে বিক্রি করে। এজন্য অনেক ফার্মেসি মালিক প্রেসক্রিপশন দেখে গ্রুপ ঠিক রেখে ব্র্যান্ড বদলে দেয়। তা ওষুধ বিক্রেতাদের কাছে লাভটাই বড়, মান নয়। তারা যে ওষুধে লাভ সেটাই দেন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কাজ হলো মাঝে মাঝে বাজার থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে মান পরীক্ষা করা। কিন্তু তাদের ল্যাবরেটরির সক্ষমতা কম। এই সুযোগ কাজে লাগায় অনেক কোম্পানি। লোকবলের অভাব ও ক্যাপাসিটি না থাকার দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না।

এবার দেখি এসব নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কী বলছে। তারা বলছে, গত দেড় বছরে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানো হয়নি। ওষুধ কোম্পানিগুলোও একই কথা বলছে। তাহলে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, ওষুধের দাম বাড়াচ্ছেন মূলত বিক্রেতারাই। কিন্তু কেন তারা অযথা দাম বাড়িয়ে এই কুকর্ম করছেন? আসলে তারা সুযোগ পাচ্ছেন। কারণ বাজার মনিটরিং এ দেশে নেই। আর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর গা ছাড়া ভাবে যা করছে, এভাবে আসলে সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যার সমাধানে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মূলে গিয়ে চালাতে হবে তৎপরতা।

পত্রিকা পড়ে জেনেছি, করোনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও নাকি সেসব ওষুধ অনেক বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে! বেশি দামের সাথে কয়েক বছর ধরে নকল ওষুধে বাজার সয়লাব হওয়ার বিষয় যুক্ত হয়েছে। রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য খেতে হয় ওষুধ। কিন্তু এখন এসব নকল ওষুধই হয়ে উঠেছে আরও অন্যসব রোগের কারণ। এ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ। আর অনেক ফার্মেসি মালিক জেনেশুনেই রোগীর হাতে তুলে দিচ্ছে নকল ওষুধ। খারাপ লাগে, দুয়েকটি ঘটনা ছাড়া এসব নিয়ে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দৃশ্যমান তৎপরতা আমরা দেখি না।

খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমাদের দেশে এখন ২৪১টি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ বানায়। আর যেকোনো ওষুধ বাজারজাত করার আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমতি নিয়ে বাজারজাত করতে হয়। কিন্তু একবার বাজারজাত করার পর সেই ওষুধের গুণগত মান নিয়ে আর কোনো রকম তদারকি হয় না। ঠিক এই সুযোগটিই কাজে লাগায় অসাধু চক্র। দেশের নামসর্বর্স্ব অনেক কোম্পানি পরে ওষুধের মান কমিয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ হলো এমন এক পণ্য, যার সঙ্গে জীবন-মৃত্যু জড়িয়ে। তাই নকল ওষুধের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে। নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এভাবে মনিটরিং করলেই কেবল এসব অপরাধী এ কাজ করতে সাহস পাবে না।

আমাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হল চিকিৎসা। তাই যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা নিরসনে উদ্যোগী হয়ে জনগণের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছে আমরা আশা করি, বর্তমানে যেসব ওষুধের চাহিদা বেশি, সেগুলোর উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে ওষুধের সংকট নিরসনে তারা ভূমিকা রাখবে। লেখাটির শুরু করেছিলাম গল্প দিয়ে, শেষেও একটি গল্প। দীর্ঘদিন চিকিৎসা করার পর তিন পাগলকে নিয়ে বসেছেন এক চিকিৎসক। চিকিৎসক জিজ্ঞেস করলেন, বলো তো, ৩ কে ৩ দিয়ে গুণ করলে কত হয়? প্রথম পাগল বলল, ৩৯৮! হতাশ হয়ে চিকিৎসক এবার দ্বিতীয় জনকেও একই প্রশ্ন করলেন। দ্বিতীয় পাগল উত্তর দিল, মঙ্গলবার। এবার চিকিৎসক তৃতীয় জনকে একই প্রশ্ন করলেন। তৃতীয় পাগল বলল, ৯! অবাক হয়ে বললেন চিকিৎসক বললেন, ভেরি গুড! এবার বলো তো, তুমি এটা কীভাবে বের করলে? তৃতীয় পাগল খুব ভাব নিয়ে বলল, খুবই সহজ! ৩৯৮ থেকে মঙ্গলবার বিয়োগ করেছি!

প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক সমকাল, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ওষুধের মান ও অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিন

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top