হাসান হামিদ
চাকরি পাওয়া আজকাল কতটা কঠিন হয়েছে তা আন্দাজ করতে আপনাকে একটা ধারণা দিচ্ছি। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি মাত্র পদের বিপরীতে আবেদন করেছেন ২ লাখ ৫৫ হাজার ২৯২ জন। চাকরি পাবেন মাত্র একজন, অথচ এর জন্য আবেদন করেছেন আড়াই লাখের বেশি লোক! বিশ্বে এমন ঘটনা আর ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। কয়েক বছর আগে ভারতে একজন নিয়োগের বিপরীতে লাখের কাছাকাছি আবেদন পড়েছিল বলে জেনেছিলাম। আমরা সেটি ভয়াবহ ভাবে ছাড়িয়ে গেছি। এটি কিন্তু আশঙ্কার খবর। পড়াশোনা শেষ করেই ছেলেমেয়েরা বেকার হয়ে যাচ্ছে। কাজ পাচ্ছে না। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের ৪৭% স্নাতক ডিগ্রিধারীই শতভাগ বেকার, মানে এরা সরকারি-বেসরকারি কোনো চাকরিই পাচ্ছে না, নিজে কিছু করতেও পারছে না। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। একটি দেশের শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায় এমন হারে বেকার থাকার অর্থই হলো শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ আছে। মোটা দাগে বললে, এ দেশের কারিকুলাম অর্ধ শত বছর আগের। উচ্চশিক্ষায় এই ব্যাকডেটেড শিক্ষাক্রম আরও চললে, বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা চলতে থাকলে আগামীতে অবস্থা আরও খারাপ হবে।
জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা তরুণ শিক্ষার্থীরা কী শিখে কাটাচ্ছে এই বিষয়টি একটি দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের তরুণ একজন শিক্ষার্থী যখন এক মালিকানা কারবারের বৈশিষ্ট্য ও সংজ্ঞা মুখস্থ করছে, সেই সময়ে উন্নত দেশের একজন শিক্ষার্থী যুগোপযোগী উদ্যোগ নিয়ে মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে যাচ্ছে। সবাইকে সেটা করতে হবে তা না, কিন্তু যা এই যুগে আর কাজে লাগবে না তা কেন শেখানো হচ্ছে এ দেশে? কেন আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে এখনও এটা হবে, সেটা হবে কেবল মুখে মুখে বলাই হচ্ছে। বাস্তবে চলছে সেই শিক্ষাই যা আসলে অচল, রুগ্ন আর বয়স্ক। অথচ স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটি বলছে, ‘আমরা ছাত্রদের প্রথম সেমিস্টারে যা শেখাই, তারা তৃতীয় সেমিস্টারে উঠতে উঠতে তা ব্যাকডেটেড হয়ে যায়’। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘যত্রতত্র অনার্স খুলে আমরা শিক্ষিত বেকার তৈরি করে ফেলেছি। আমরা শিক্ষিত বেকার তৈরি করতে চাই না’। তাঁকে ধন্যবাদ যে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন। প্রিয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আমার জিজ্ঞাসা, এ দেশে কবে থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স ‘শ্রমবাজারের চাহিদা’ মোতাবেক পড়ানো হবে? আমরা অপেক্ষা করছি উচ্চ শিক্ষায় বড় একটা পরিবর্তন হবে সেই আশা নিয়ে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগের দিন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতেই আমাদের মূল নজর’। এই কথাটি বলার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ দেশে এখন কর্মসংস্থান তৈরি করার কাজটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য সরকারের পরিকল্পনা থাকা চাই সুস্পষ্ট। দেশে লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর বাংলাদেশে বেসরকারি খাতেও কোনো কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। উল্টো আগে যারা চাকরি করতেন তাদের কেউ কেউ কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর আমাদের দেশে গড়ে অন্তত ২৬ থেকে ২৭ লাখ লোক নতুন করে শ্রমবাজারে আসেন। তাহলে গত দুই বছরে ৫২ থেকে ৫৪ লাখ নতুন লোক তৈরি হয়েছেন, কিন্তু করোনার কারণে তাদের কারোই চাকরি হয়নি। আইএলও বলছে, বাংলাদেশে আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি। আর এখন বেকারের সংখ্যা ৪ কোটি। এই বেকারের মধ্যে শিক্ষিত বেকার সবচেয়ে বেশি।
গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্নাতক পাস ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকছেন। আর পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনশক্তির (১৫ থেকে ৬৪ বছর) মাত্র ৫৮ দশমিক ২৩ শতাংশ কর্মরত অথবা বেকার। বাকি ৪১ দশমিক ৭৭ শতাংশ শ্রমবাজারের বাইরে অবস্থান করছেন। বিআইডিএস জরিপ অনুযায়ী, দেশে এসএসসি উত্তীর্ণদের পৌনে ২৭ শতাংশ, এইচএসসি উত্তীর্ণদের প্রায় ২৮ শতাংশ, স্নাতকদের ৩৬ শতাংশ, স্নাতকোত্তরদের ৩৪ শতাংশ অর্থাৎ সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের ৩৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বেকার। এই বেকারত্ব আরও বাড়বে। কারণ আগামী দশ বছরে কোনো শিল্প খাতে কেমন কর্মী দরকার হবে এবং কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন পড়বে- এই পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হবে। শিল্প খাতের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী আনবে বিদেশ থেকে। তাতে লাখ লাখ ডলার চলে যাবে বিদেশে। তবু আমরা এসবই পড়তে পড়তে মরতে থাকব, যা আমাদের দক্ষ করে না, যুগের উপযোগী করে না। এর থেকে দ্রুত বের হওয়া দরকার। উচ্চ শিক্ষায় এমন বিষয়ই এদেশে বেশি পড়ানো হয়, যা কোনো কাজেই লাগে না। তারুণ্যের কী দারুণ অপচয়!
আর এই অপচয়ের ফলাফল স্বরূপ বাংলাদেশ দক্ষ লোক তৈরিতে অনেক পিছিয়ে আছে। পরিসংখ্যান বলছে, জার্মানিতে প্রায় ৭৩ শতাংশ জনসংখ্যা দক্ষ। আর জাপানে ৬৬ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরে ৬৫ শতাংশ লোক দক্ষ। এভাবে অস্ট্রেলিয়াতে ৬০ শতাংশ, চীনে ৫৫ শতাংশ দক্ষ। এবার আসেন আমাদের অবস্থা কী তা জানি। সার্বিকভাবে আমাদের দেশে স্বল্প দক্ষ ও দক্ষ জনশক্তি ৩৮ শতাংশ বলা হলেও কারিগরিভাবে দক্ষ, মধ্যমানে দক্ষ জনশক্তি মাত্র ১৪ শতাংশ। অবশ্য আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা ও বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটি মূলত ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর মানে দাঁড়াল, আমাদের দেশের চলমান উচ্চশিক্ষা অনেকখানিই ব্যর্থ। এ দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৬০টির মতো, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে প্রায় একশ’র কাছাকাছি। আছে বিশেষায়িত প্রকৌশল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, টেক্সটাইল কলেজ এবং প্রায় অর্ধশত পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। এত এত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান আছে তবু কেন শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষতা তৈরি হচ্ছে না? কারণ ওই যে যুগের উপযোগী কারিকুলাম, ল্যাব সুবিধা, যোগ্য শিক্ষক এসব ঠিকঠাক নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যতটা আছে, তা দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। আর কিছুদিন পর পর বিশ্বের সেরা ৫০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই বাংলাদেশের একটাও, ১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই দেশের কোনোটি এসব খবরে আমরা হতাশ হচ্ছি। অবশ্য কর্তারা বলছেন, তারা এসব র্যাংকিং-এ মনোযোগী নন।
কর্তারা যে দিকেই মনোযোগ দেন, দেশে প্রতিদিন শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। চাকরির বাজারে যে ধরনের লোকের চাহিদা চলছে, সে রকম দক্ষতার লোক বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না। ফলে শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীরা বেকার থাকছেন গণহারে। এরপর উৎপাদনশীল ও কৃষি খাতে অনেক সম্ভাবনা আছে এ দেশে। এই দুটি খাতে আবার সাধারণ শিক্ষিত তরুণদের কাজের সুযোগ অনেক কম। এ দুই খাতে কারিগরিভাবে দক্ষ লোকের চাহিদা আছে। যারা চাকরি চাচ্ছেন, তারা এই খাতে আগ্রহী নন। তারা টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে কেবল সই করবেন আর মাস শেষে বেতন গুণবেন এসব ভাবেন। সুতরাং সংকট আর কাটছে না।
যাই হোক। উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বললাম। লেখাটি শেষ করার আগে মাধ্যমিক নিয়ে একটু বলি। মাধ্যমিকেও কয়েক সপ্তাহ ধরে শিক্ষায় এক বিপ্লব আসতেছে বলে যে প্রচারণা চলছে, তা নিয়েও ভয় আছে। কয়েক বছর আগে অতি উৎসাহ নিয়ে আমদানি করা হয়েছিল তথাকথিত সৃজনশীল পদ্ধতি। সবাই ভেবেছিল, এবার সাংঘাতিক কিছু একটা হবে। পরে দেখা গেল, যে লাউ সে কদু। সৃজনশীল প্রশ্ন আসলে পুরোনো ধাঁচের প্রশ্নের কাছাকাছি একটা কাঠামোই। এখন যেটা হতে যাচ্ছে সেটায় প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে, কোনো পরীক্ষা হবে না। বেশ ভালো। আর উপরের শ্রেণিগুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ, ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে ক্লাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু এই ধারাবাহিক মূল্যায়ন নিয়েই আসলে আশঙ্কা আছে। আমাদের দেশে মাধ্যমিকের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষার কথা আমরা কিন্তু জানি। এভাবে মন মতো একটি শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়নে লিখে ফেলা হবে। তাতে আদৌ কি শিক্ষায় বিরাট কিছু হয়ে যাবে?
মনে রাখা দরকার, এখনকার সময় দ্রুত পরিবর্তনশীল। যুগের সাথে মিলিয়ে, বাজারের চাহিদা উপযোগী কারিকুলাম চালু করতে হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স সব ঢেলে সাজাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বিষয় বন্ধ করতে পারলেই ভাল। সুযোগ কম যেসব বিষয়ের সেসবের আসনও কম রাখতে হবে। মানে হলো গৎবাঁধা বিষয়াদি সীমিত করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী নতুন বিষয়, দেশে ও প্রবাসের শ্রমবাজার উপযোগী শিক্ষা কোর্সের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। বাজারভিত্তিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করার সময় এসে গেছে।