এক।
এই পৃথিবীতে আমরা না চাইলেও একটি হাত আমাদের দিকে সব সময় বাড়ানো থাকে; যার অর্থ এই— আমি আছি, কোনো ভয় নেই। সে হাতটি বাবার। বাবা যদিও একজন পুরুষ অভিভাবক হিসেবে, সন্তানের জনক হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকেন; তথাপি বাবা এর চেয়ে আরও বেশি কিছু। বাবার বাড়ানো সেই হাতটি আমি পাইনি। আমি যখন ধরেছি পৃথিবীর আঙুল, আমার বাবা তখন নক্ষত্র। আমরা মাকে বাবার ভূমিকায় দেখেছি ছোটবেলায়। আমাদের এতগুলো ভাই-বোন; বাবা না থাকায় আমার মা কেমন করে পাড়ি দিয়েছেন সেই পথ, ভাবতে পারি না! আর একজন বাবা আসলে কেমন হয়, কীভাবে সন্তানের গালে চুমু খায়, সন্তানের সাফল্যে বাবার চোখ কতটা ভিজে যায় আনন্দে; আমি এসবের কিছুই জানি না। আমি জানি না, একজন বাবা আসলেই কেমন হয়!
আমি হাওরের এক পাড়া গায়ে জন্মেছি। আমি যেদিন জন্মেছি, বৈশাখের কড়া যে দুপুরে আমি নেমেছি পৃথিবীতে; আমার বাবা সেদিন কী করেছিলেন আমি জানি না, আমি কথা বলতে যখন শিখেছি, বাবা কতটা উচ্ছল ছিলেন অথবা কী স্বপ্ন ছিল তাঁর আমাকে নিয়ে, এসবের কিছুই জানি না আমি। আমার তিন বছর বয়সেই আমি বাবাকে হারিয়েছি। বাবাকে নিয়ে কোনো স্মৃতি আমার নেই। আমার কোনো বিকেল নেই বাবার আঙুল ধরে হাঁটার, আমার কোনো দুপুর নেই বাবার লোমশ বুকে চিত হয়ে শুয়ে থাকার, আমার কেবল বাবার জন্য হাহাকারের সহস্র রাত্রি আছে; আমার কেবল বাবাহীন একটা মৃত্যুর মতো জীবন আছে।
আমার বাবা ছিলেন আমাদের গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। বাবা সিলেবাসের বাইরে বই তৈরি করে পড়াতেন। তাঁর নিজের লেখা অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গান তাঁর স্কুলে পড়ানো হতো। আমি যখন একটু পড়তে শিখেছি, বাবা যদিও নেই; বাবার সেসব খাতাপত্র, বই হাতড়িয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। আমার বাবা ছবি আঁকতেন। ভয়াবহ সুন্দর ছবি। তিনি লিখতেন। পত্রিকায় কয়েকটি লেখা ছাপাও হয়েছিল তাঁর। তবে জীবনের সব স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে আকস্মিক তিনি চলে গিয়েছেন। তাঁর লেখা খাতাগুলো দেখলে আমি বুঝতে পারি, আমার বাবার স্বপ্ন আসলে কী ছিল।
মাকে আমরা আম্মা বলি। বাবা যদি থাকতেন, বাবাকে নিশ্চয়ই আব্বা ডাকতাম। ছোটবেলায় বেড়ে ওঠার সে সময়টাতে বাবার প্রয়োজনটা আমি তেমন করে বুঝিনি। আজ বুঝতে পারি, বাবার বাড়ানো হাতটি কতটা প্রয়োজন! আমরা প্রতিটি ঈদ বাবাকে ছাড়া কাটাই। ছোটবেলায় এতটা বুঝিনি, বাবা থাকলে আমাদের ঈদটা সব সময় এখন যেমন হয়, হয়তো অন্যরকম হতো।
দুই।
ফোনের ওপাশে আম্মা কাঁপা গলায় বললেন, আচ্ছা, ঈদের পরদিনই তাহলে আয়।
এই প্রথম ঈদে আমি বাড়ি যেতে পারছি না। ঈদে ঢাকায় থাকছি। আম্মাকে ছাড়া ঈদ। ভাবতে পারি না। পরিকল্পনা ছিল ঈদে যাব এবং তারপর আম্মাকেসহ ঢাকায় ফিরব। একটা বিশেষ কারণে ঈদের আগে যাচ্ছি না। আম্মাই বললেন, ঈদের আগে দরকার নেই। ঈদের পরদিন যেন যাই এবং তারপর আম্মাকে নিয়ে আসি।
আম্মার সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, আমি তখন আমার অফিসে। ফোন রাখার পর বারবার ছোটবেলার ঈদের কথা মনে হচ্ছিল। কথাগুলো খুব বেশি দিন আগের নয়। এক যুগেরও কম সময়ে আমরা ছেলেরা হাজার বছরের ব্যস্ততা লালন করে ফেলি। আর সেটার জন্য কষ্ট কি আমাদেরও কম হয়?
আমার আব্বা আমাদের গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। আব্বা যখন মারা যান, আমরা ভাইবোনেরা সবাই তখন ছোট ছোট। আমার বয়স মাত্র চার বছর। আমাদের এতগুলো ভাই-বোন, আম্মা আমাদের আগলে রেখে বড় করেছেন। আমাদের পড়িয়েছেন। তাঁর ওপর দিয়ে কী ঝড় গেছে, তিনি এতসব কীভাবে সামাল দিয়েছেন, তা ভাবলে এখন অবাক হই। আম্মা এত কিছু কীভাবে করতেন আমাদের জন্য!
আমি সুনামগঞ্জের হাওরপাড়ের এক অজপাড়া গ্রাম আবিদনগরে জন্মেছি। আমার জন্মের দিন আব্বা অসুস্থ ছিলেন। আমি যখন নামলাম এই পৃথিবী নামক গ্রহে, আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমার ছোট ছোট হাত, ছোট চোখ, চোখের পাতা। আর তারপর সেই ছোট আর শক্তিহীন হাতকে আম্মা শিখিয়েছেন কীভাবে ধরতে হবে পৃথিবীর আঙুল! আম্মা আমাদের কোনো অভাব কখনই বুঝতে দেননি। এতগুলো ছেলেমেয়ের এত এত জিনিসপত্র, জামা-জুতো, বই-খাতা কোনো কিছুর অভাব রাখতেন না। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি আম্মার তাতে কত কষ্ট করতে হতো। আমাদের গ্রামে বড় গৃহস্থ ছিল। আর সবকিছু তদারকি আম্মাই একাই করতেন। কাজের লোক সামাল দেওয়া, এত জমির খোঁজখবর রাখা, চাট্টিখানি কথা নয়। এ কারণে আম্মাকে বরাবর আমার বুদ্ধিজীবী মনে হয়।
ছোটবেলায় দেখতাম, ঈদের আগে সবার, বিশেষ করে ছোটদের ঈদ নিয়ে সে কী উত্তেজনা! আম্মা যখন পিঠা বানাতেন, আমরা ভাই-বোনেরা গোল হয়ে বসতাম। আশপাশের ঘর থেকে পিঠা আসত, আমরাও অন্যদের দিয়ে আসতাম। আর ঈদ উপলক্ষে দুই সপ্তাহ আমরা বইয়ের ধারে কাছেও যেতাম না। ঈদের দিন খুব ভোরে গোসল করতে আমরা দল বেঁধে নদীতে ঝাঁপ দিতাম। সেই অপার আনন্দ এখনকার ঈদে খুঁজে পাই না তেমন।
ছোটবেলায় আমার একবার খুব জ্বর হলো। তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। আমি জ্বর হলে কিছু খেতে পারতাম না। এ কারণে আম্মাও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিতেন। আমি তখনই বুঝলাম, আমার জ্বর আর আম্মার জ্বরে কোনো ব্যবধান নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম, আমি কোচিং-এ পড়িয়ে, টিউশনির টাকা জমিয়ে ঈদে সবার জন্য কিছু না কিছু নিতাম। মাঝে মাঝে আম্মার জন্য দুইটা শাড়ি কিনলে, আম্মা বলতেন—দুইটা কেন? কিন্তু আম্মা কী যে খুশি হতেন।
আমি এখন চোখ বন্ধ করে আছি, ঈদের পরদিনটা যদি আগামীকাল হতো!
তিন।
রাত এগারোটা বাজে। বেইলি রোডে আমি আর রুনা ঘুরছি, ঈদের আগের রাত।
বন্যার পানি মতো হু হু করা মানুষের ভীড়। এই ভীড় ঠেলে আমরা নিয়েছি কিছু টাওয়েল, মিনি সাইজের কাঁথা, বালিশ এসব। কয়েক সপ্তাহ পর প্রথম বাবা হব, এমন দুর্দান্ত অনুভূতি আমার ভেতরে। আশেপাশের সবকিছু কচি লেবুপাতা রঙয়ের মতো কোমল মনে হচ্ছিল আমার কাছে। অনাগত রাজকন্যার কী নাম হতে পারে তা ভেবে মাসখানেক না ঘুমানো ফোলা চোখ নিয়ে স্বপ্নময় এক অপেক্ষা চলছে তখন। বাসায় ফিরতে সে রাতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
বাসায় প্রতি রাতে আমি কিছু না কিছু লিখি। সেদিনও কিছু লিখতে চেষ্টা করলাম। লেখা একেবারেই হচ্ছিল না। আমার অনাগত সন্তানের মুখ চোখের সামনে বারবার ভাসছিল। ভাবলাম আমার অনাগত মেয়ের কাছে একটা চিঠি লেখা যায়। কিন্তু সেই চিঠির উপযুক্ত কোনো শব্দ আমি আর খুঁজে পাই না। কোনো শব্দই আমার যথার্থ মনে হচ্ছিল না। আমার মেয়েকে সম্বোধনের যোগ্যতম শব্দের খুঁজে রাত তিনটা বাজিয়ে ফেললাম। কিন্তু এক লাইনও লেখা হল না। আসলে সেই অনুভূতির কাছে পৃথিবীর অন্য যে কোনো সৃষ্টি তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। আরও একটি কারণ ছিল। ভাবনার ভেতরে উঁকি মারছিল আরও একটি মুখ; আমার মায়ের। ঈদে এই প্রথম বাড়ি যাচ্ছি না। আম্মার জন্য মন খারাপ লাগছিল। দুইয়ে মিলে আনন্দ বেদনার এক মিশেল অনুভূতি আমার মাঝে। তারপর কখন ঘুমিয়েছি টের পাইনি।
সকালে ঘুম ভাঙল রুনার ডাকে। রুনাকে বিষন্ন দেখে আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। আমার সকালে গোসল সেরে জাতীয় ঈদ্গাহ, বঙ্গভবন এবং তারপর মিরপুর যাবার কথা। রুনা বলল, একটু সমস্যা হচ্ছে। ডাক্তারকে ফোন করতে হবে। আমি যতদূর জানি, রুনা খুব নরম স্বভাবের মেয়ে। সাধারণ নাটকের নায়িকার কান্নার সিন দেখেও সে অঝোর কাঁদতে পারে।
আমি তখনই ডাক্তারকে ফোন দিলাম। ডাক্তারের ফোন বন্ধ। রুনা যে দুজন ডাক্তারের তত্ত্বাবধায়নে এতোদিন চিকিৎসা নিয়েছে তারা একজন স্কয়ার হাসপাতালের, আরেকজন বারডেমের। দুজনই অসম্ভব ভালো মানুষ। একজন অবশ্য কথায় কথায় রুনাকে ধমকাতেন। সেই আন্টির ভালোবাসার ধরনই সম্ভবত ধমক। এ জগতে ভালোবাসার ভাষা বড় বিচিত্র। একে ব্যাখ্যা করা যায় না।
দ্বিতীয়বার চেষ্টা করে বারডেমের ডাক্তারকে পাওয়া গেল। তিনি এই মুহুর্তে গ্রামের বাড়িতে আছেন। ঈদ করতে গেছেন। সব শুনে আমাকে কোনো চিন্তা না করতে বললেন। আর সেই সাথে বললেন, আমরা যেন এখনই হাসপাতালে চলে যাই।
ঈদের দিন। সব রাস্তাঘাট ফাঁকা। খুব দ্রুতই সেগুনবাগিচায় বারডেমের মা ও শিশুদের যে নতুন ইউনিট সেখানে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি পৌঁছার আগেই ডাক্তার সেখানে ফোন দিয়েছেন। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। ইমারজেন্সিতে একজন ইন্টার্নি ডাক্তার ছাড়া আর কেউ নেই। ঈদের দিন সকাল হওয়াতে আর কাউকেই তখন সেখানে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি আবার ডাক্তারকে ফোন দিলাম। রুনার সাথে কথা বলে উনি জানালেন, আজকেই অপারেশন করতে হবে এবং বেবি প্রিম্যাচিউর হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর অপারেশন নির্ধারিত তারিখের চার সপ্তাহ আগে হচ্ছে। সেজন্য বেবিকে এনআইসিওতে কিছুদিন রাখতে হবে।
ডাক্তার বললেন, তিনি গ্রামের বাড়ি না থাকলে সমস্যা ছিল না। আর এখন রওয়ানা দিলেও তার আসতে মধ্যরাত হবে। এত দেরি করা যাবে না। আবার হাসপাতালে কোনো এনআইসিইউ খালি নেই। তবে উনি নিজেই কয়েক জায়গায় ফোন দিয়ে আমাকে আবার জানাচ্ছেন বলে ফোন রাখলেন। মিনিট সাতেক পর উনি জানালেন। আমার এই সাত মিনিটকে সাত বছর মনে হল। এই সাত মিনিটে আমি সাতশ বার রুনাকে জিজ্ঞেস করেছি, ওর খুব খারাপ লাগছে কিনা! সে আমার বিমর্ষ অবস্থা দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
আমি এর মধ্যে আলী ভাইকে ফোন দিয়েছি। আলী ভাই হলেন আমার সব বিষয়ের সমাধানকারী দুলাভাই। আমার ঠাণ্ডা, গরম, বৃষ্টি, বাদল সব অনুভূতি এই ঢাকা শহরে যাকে সবার আগে জানাই তিনিই হলেন আলী ভাই। আলী ভাইয়ের বড় বোন কোহিনূর আপা। আপা হলেন অসাধারণ একজন মানুষ। পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্মায়, যাদের কাজকর্ম দেখলে মনে হয়, অন্য সবাইকে ভালোবাসবার বিশাল এক দায়িত্ব নিয়ে তারা এসেছেন। আপা হলেন এই দলের। আপার পরামর্শে বিকেল চারটায় রুনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। ডাক্তার এবং হাসপাতালের মালিক ছিলেন আপার এক বান্ধবী। সদলবলে তখনই ডাক্তার এলেন।
রুনা অপারেশন থিয়েটারে। আমরা চারজন ওটির বাইরে সোফায় বসা। চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর একজন নার্স আসলেন। বাচ্চা কোলে। এসে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলের বাবা কে?
আমরা চুপচাপ। উনি আবার বললেন, ছেলের বাবা কে?
আলী ভাই আমাকে বললেন, কী মিয়া, যাও না কেন?
আমি আস্তে করে বললাম, আমার মেয়ে হবে জানতাম। এটা অন্য কারো বেবি হতে পারে।
তখনই মনে হলো, আজ ঈদের দিন এবং হাসপাতালের ওটিতে রুনারই কেবল অপারেশন হয়েছে। গত কয়েক মাস মেয়ের বাবা হচ্ছি এমন অনুভূতি লালন করা আমি আমার ছেলেকে কোলে নিলাম।
ডাক্তার হাসলেন এবং বললেন, আপনার ছেলে তো এডাল্ট। সে সময় মতোই পৃথিবীতে এসেছে। আগের ডাক্তার ভুলভাল বলেছেন।
রুনার সাথে তার প্রথম মা হবার সমস্ত রাতটি জেগে কাটিয়েছেন কোহিনূর আপা। আমার ছেলে এই পৃথিবীতে এসে প্রথম রাতটি কাটিয়েছে আপার কোলে। আপাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি। আজ বলি। আপা, আপনার কাছে আমার অনেকগুলো ঋণ। যেগুলো কোনোদিন শোধ করা যাবে না। শোধ করতেও চাই না। কিছু ঋণ ভালোবাসার শীতল জলে ভেজানো থাকে। জিওল মাছের মতো মাঝে মাঝে সেই ঋণ নড়ে ওঠে। আর আমি টের পাই তাতে জমে থাকা ভালোবাসাটিরে। তখন মনে হয়, কী আশ্চর্য চমৎকার এই পৃথিবী এবং আমাদের বেঁচে থাকা!