ই-কমার্সে অস্থিরতা কমাতে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিন

ইলেকট্রনিক কমার্স বা ই-কমার্স মূলত একটি বাণিজ্য ক্ষেত্র যেখানে কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেম তথা ইন্টারনেটের মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। এটি যখন আমাদের দেশে শুরু হয় তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, বাঙালি অনেক দোকান ঘুরে শতশত পণ্য দেখে এরপর একটি কেনে। এরা কি কেবল মোবাইলে বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে একটি পণ্য দেখে তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্রয় করবে? কিন্তু  আমরা জানি, মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে ই-কমার্স হাটি হাটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। আর আমাদের দেশে বলা যায় ২০১৩ সালের দিকে ই-কমার্স গতি পেতে শুরু করে। বর্তমানে কিছু বিতর্কিত ই-কমার্স সাইটের কারণে শুরুর দিকের যে আস্থা ছিল মানুষের, সেটি হারাতে বসেছে। আর এই আস্থাহীনতা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতা। কিন্তু কয়েকজন অসাধু প্রতারকদের কারণে ই-কমার্স খাতের সম্ভাবনা নষ্ট হোক বা ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হোক তা আমরা চাই না।  ই-কমার্স বিকশিত হওয়ার সময়টিতে শুরু হলো করোনা সংক্রমণ। এই সময়ে ই-কমার্স খাতের প্রসার হয়েছে কল্পনাতীত। একটি পরিসংখ্যানের তথ্য দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করব। তথ্য মতে, ২০২০ সালে দেশে ই-কমার্স খাতে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের বেশি লেনদেন হয়েছে। গত বছর ফেসবুকের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৩২০ কোটি টাকা, যা আগামীতে আরও বাড়বে। এতেই বোঝা যাচ্ছে, এই সেক্টরের গুরুত্ব বর্তমান বাণিজ্যখাতে কতখানি।

বেশ কিছুদিন ধরে কোনো কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে সময়মতো পণ্য সরবরাহ করেনি। প্রতারণা করে গ্রাহক ঠকানোর অভিযোগ আছে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ইভ্যালি নিয়ে যখন আলোচনা-সমালোচনা দেশজুড়ে, ঠিক তখন গত ১৬ আগস্ট রাজধানীর গুলশান-১ নম্বরে সড়ক অবরোধ করেন ই-অরেঞ্জ নামের একটি সাইটের গ্রাহকরা। এই ঘটনার পর ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। পুলিশের দেওয়া তথ্য থেকে আমরা জেনেছি, গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া ৫০০ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরপর নড়েচড়ে বসেছে এই খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা, বিক্রেতা ও প্রতিষ্ঠান। খবর নিয়ে জেনেছি, পুলিশ সদরদপ্তর, র‌্যাব, সিআইডির সাইবার ইউনিটও পৃথকভাবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছে। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ ছাড়াও এই তালিকায় রয়েছে আলেশা মার্ট, কিউকম, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, সিরাজগঞ্জ শপ, ধামাকা শপিং ডটকম, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, এসকে ট্রেডার্স ও মোটরস। এদের কেউ কেউ গ্রাহককে কথা দিয়ে সেটি না রাখার কারণে, ব্যাপক ডিসকাউন্টের বিতর্কিত মডেলের ব্যবসার ফলে ই-কমার্সে এখন আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। কিন্তু দ্রুত এই অস্থিরতা কমাতে পদক্ষেপ না নিলে সম্ভাবনাময় ও সময়োপযোগী এই খাত সীমাহীন ক্ষতির মুখে পড়বে।

এবার ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাবের দেওয়া কিছু পরিসংখ্যানে নজর দেব। তারা বলছে, দেশের প্রায় ২ শতাংশ মানুষ এখন ই-কমার্সে কেনাকাটা করেন। ছোট-বড় মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান এই খাতে কাজ করছে। আর ফেসবুক পেজ খুলে ব্যবসা করছে আরও ৫০ হাজার লোক। বর্তমানে অর্ডার সরবরাহ হচ্ছে দৈনিক গড়ে দুই লাখেরও বেশি। সবচেয়ে ভালো খবর হলো, প্রচলিত ধারার বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ই-কমার্স চালু করছে। এইসব দারুণ কিছু তথ্যের পাশাপাশি সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাপক ডিসকাউন্টের ফাঁদে দেশের প্রায় পাঁচ লাখ লোকের ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আটকা পড়েছে। এই কাজটি কীভাবে হলো? আসলে দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর অনেক নতুন ই-কমার্স সাইট চালু হয়েছে নামে-বেনামে। এর মধ্যে কোনোটি আবার নিজেদের পরিচিতির জন্য ব্যাপক ডিসকাউন্ট পদ্ধতিতে ব্যবসা শুরু করে। আর অসম্ভব আকর্ষণীয় অফারে লোকজন কম দামে জিনিস পেতে এদের অগ্রীম টাকা দিয়েছেন। এরপর অল্প কয়েকজন সেই পণ্য পেলেও বেশিরভাগ পণ্য বা টাকা না পেয়ে এখন দ্বারস্থ হচ্ছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত ১৯টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা ১৩ হাজার ৩১৭টি অভিযোগ করেছেন। তাই স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে নিয়মনীতির ব্যত্যয় ঘটছে। সব ধরনের অসংগতি দূর করে এই খাতে স্বচ্ছতা আনতে সর্বাগ্রে জরুরি নীতিমালার বাস্তবায়ন।

সামনের দিনে ই-কমার্স খাতে যাতে বাজে পরিস্থিতি তৈরি না হয় সেজন্য একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই মাসে। সেই নির্দেশনার পুরোটা আমি পড়ে দেখেছি। সেখানে গ্রাহক কর্তৃক আগাম অর্থ পরিশোধ, সময়মতো পণ্য সরবরাহ, লেনদেন প্রক্রিয়া এসব কিছুই সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসির লক্ষ্যে বলা হয়েছে, ডিজিটাল ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণের মাধ্যমে ‘জাতীয় কমার্স নীতিমালা-২০২০ এর সফল বাস্তবায়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা। আর এর উদ্দেশ্য হিসেবে বলা উল্লেখ করা হয়েছে, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; ডিজিটাল ব্যবসার প্রসারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ডিজিটাল ব্যবসায় শৃঙ্খলা আনয়নের মাধ্যমে ভোক্তার আস্থা বৃদ্ধি ও অধিকার নিশ্চিতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য বা পণ্য সামগ্রী ডেলিভারিম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার নিকট হস্তান্তর করতে হবে এবং ক্রেতাকে তা টেলিফোন, ই-মেইল বা এসএমএস এর মাধ্যমে জানাতে হবে। পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়ে থাকলে ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী সর্বোচ্চ ৫ দিন এবং ভিন্ন শহরে বা গ্রামে অবস্থিত হলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি প্রদান করতে হবে। অভিযোগ ও প্রতিকার সম্পর্কে নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, পণ্য ও সেবার বিষয়ে অভিযোগের জন্য মার্কেটপ্লেস কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অভিযোগ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাপ বা প্ল্যাটফর্মে ফোন নম্বর, ইমেইল বা অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। কোন পণ্যের বা সেবা প্রদান বিষয়ে ক্রেতার অভিযোগ রেকর্ডের যথাযথ ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং যেকোন অভিযোগ প্রাপ্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমাধানের ব্যবস্থা করে ক্রেতাকে ফোন, ই-মেইল বা এসএমএস’র মাধ্যমে তা জানাতে হবে। সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পর মানুষের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত কোন কারণে ক্রেতার চাহিদা মোতাবেক পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব না হলে, অর্ডার দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্রেতাকে তা ফোন, এসএমএস, ই-মেইল বা অন্যান্য মাধ্যমে জানাতে হবে। এক্ষেত্রে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত প্রদান করতে হবে এবং অন্য কোন পণ্য ক্রয় করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধ্য করা যাবে না। আর ক্যাশব্যাক অফার মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর হতে হবে। ক্যাশব্যাক অফার বা মূল্য ছাড় অফারের ঘোষিত অর্থ সংশ্লিষ্ট পণ্য বা সেবা বিক্রয় সম্পন্ন হওয়ার পর কোন ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওয়ালেটে জমা রাখা যাবে না। কিন্তু এই নির্দেশনার যদি বাস্তবায়ন না হয়, সেটি মানা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা না হয়, তাহলে আদৌ কি কোনো লাভ হবে?

আমাদের মনে রাখতে হবে, ই-কমার্স কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো এই খাতের ব্যবহার কে কীভাবে করছে সেটি নিয়ে। আর গ্রাহকের আস্থা অর্জন যদি না করা যায় তাহলে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সৎ উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা। তাই এই খাতের বিকাশে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ জন্য জোর দিতে হবে অটোমেশনে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্নিষ্ট সব বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার বিষয়গুলোও সমভাবেই জরুরি। আমরা চাই না, কয়েকজন প্রতারকদের কারণে ই-কমার্স খাত ভূলুণ্ঠিত হোক। প্রশাসনের কড়া নজরদারি, ভোক্তার সতর্কতা এসব নিয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে নির্দেশিকা দিয়েছে, তার বাস্তবায়ন করতে পারলে অনেক সমস্যা থাকবে না। আর আমরা আশাবাদী স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে খুলে যেতে পারে ই-কমার্সের নতুন দিগন্ত, যাতে উপকৃত হব আমরা সবাই।

প্রকাশিত পত্রিকা- সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২

ই-কমার্সে অস্থিরতা কমাতে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিন

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Scroll to top