শূন্য দশকের কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের ‘আলাদিনের গ্রামে’ বইটি ২০১৬ সালে চৈতন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছিল। আমি সংগ্রহ করি ২০১৭ সালে। প্রথম সংস্করণের কপিটিই সেবার সংগ্রহ করেছিলাম। কারণ এ কবি সম্পর্কে আমার আলাদা আগ্রহ আছে। পরে জেনেছি, এই ‘আলাদিনের গ্রামে’ বইটির দুটি সংস্করণ পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। এবার নবরূপে বইটি প্রকাশ করেছে আদর্শ প্রকাশনী। সঙ্গত কারণেই সম্প্রতি আবারও ঘুরে এলাম ‘আলাদিনের গ্রামে’, আমাকে টেনে নিয়ে গেল, মন্ত্রমুগ্ধ করল; এরপর আমি এর থেকে আর ফিরতে চাইলাম না। এর মধ্যে দু’সপ্তাহ কেটে গেল। আবার পাঠ করলাম; এবং আবারও!
বইটি নিয়ে লেখার আগে কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের পূর্বে প্রকাশিত সাক্ষাৎকার থেকে তাঁর কিছু বয়ান আমার ভাষায় উল্লেখের লোভ সামলাতে পারছি না। আর এই লোভটিকে আমি আশ্রয় দিতে চাই। যতদূর জেনেছি, কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের প্রত্যেকটি বইয়ের ক্ষেত্রে আলাদা রকম প্রস্তুতি থাকে। শুধু কিছু কবিতা থরে-বিথরে সাজিয়ে মলাটবন্দি করে একটি বই করতে তিনি একেবারেই নারাজ। তিনি মনে করেন, একজন কবির কাছে তার একেকটি বই হলো একেকটি স্বতন্ত্র জগৎ। ফলে যেহেতু কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের ভিতরে এই সব বিবেচনা বোধ কাজ করে, তাই একটি বই করার ক্ষেত্রে মনে মনে প্রস্তুতি চলতে থাকে। অবশ্য আমরা তাঁর পাঠকেরা কেউ তা টের পাই না, কোনো দিন জানতেও পারি না, সেই প্রস্তুতি কোথায় গিয়ে শেষ হয়। লেখাটির শুরুতেই ‘আলাদিনের গ্রামে’ বই থেকে কয়েক লাইন পড়তে চাই,
‘‘ঘুমিয়ে পড়েছ ভেবে ডাকিনি পৃথিবী
এখানে ফাঁদের তলে বাতাসে লোহিত
দু’টুকরো স্তব্ধতা লিখি, স্বর্গরক্ষী হাসে
নিমেষে কটাক্ষ মেলে তাকায় কামিনী,
তপোবন চোখে নিয়ে মৃগয়াবাগানে
ফুলের পালকে জাগে ভ্রমর-রাক্ষসী
রমণী সে— আঁখিজুড়ে পেট্রলে সজ্জিত;
সেই গন্ধে আলাদিন রচেছি তোমাকে—’’
বইটির নাম আরব্য রজনী থেকে ধার করা। হাতে নিয়েই আমার মন বলছিল, এই চোখ, এই হাত; ধার দিও একদিন! পড়ার আগে আমার মনে হল, এতে কি তবে বাঙালি কোনো আলাদিনের কথা আছে? পড়তে পড়তে মনে হল, এ যেন এক নতুন ধারার কাব্যগ্রন্থ। পাঠ শেষ করে এখন বলতে পারি, ‘আলাদিনের গ্রামে’র পুরো স্বাদ পেতে, এর গভীর মূল্যায়নে পাঠকের উত্তরাধুনিক সাহিত্যের ব্যাপারে অল্প-বিস্তর ধারণা থাকলে ভাল হবে। এই বইয়ের লেখাগুলোর প্রতিটি শব্দ আলাদা এক মায়া তৈরি করে, পাঠে মন ও মগজে কাজ করে এক অজানা ঘোর লাগা। সেই ঘোরের মাঝেই পাঠকের মনে পড়ে, কাঠামোগত দিক থেকে কবিতা নানা রকম। যুগে যুগে কবিরা কবিতার বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোতে পরিবর্তন এনেছেন বলে জানি। আর এও জানি যে, উত্তরাধুনিকতা আগের সবকিছুকে ভাঙতে চায়। সম্ভবত সমগ্রকে ভেঙে খন্ডিতভাবে বিশ্লেষণ করতে চায় এই উত্তরাধুনিকতা। এবং সে কাঠামো চায় না, চায় সংস্কার। কেন তা? কারণ হিসেবে যুক্তি দেখানো হয়, কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামোর ভিতর থেকে প্রকৃত অর্থকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, কেননা প্রকৃত অর্থ লুকিয়ে থাকে গহীনে। আর সেই অর্থকে খুঁজতে হলে কাঠামোকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। কিন্তু কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের ‘আলাদিনের গ্রামে’ পড়ে আমার মনে হচ্ছে, সব সময় অর্থ পেতে কাঠামো ভাঙতে হয় না! তাঁর কবিতাগুলো শব্দ আর ভাবের এমন এক ব্যঞ্জনার মিশেল, যা প্রচলিত কাঠামো ভেঙে তৈরি করেছে অদ্ভুত নতুন এক কাঠামো। এখানেই এ কবির শক্তির প্রকাশ। আর কবিতা তো হচ্ছে আসলে একজন কবির উপলব্ধির বিশেষ রুপ। একটি কবিতা একজন পাঠকের মনকে তুমুলভাবে আন্দোলিত করতে পারে, দাঁড় করাতে পারে জীবনের অচেনা বাঁকের মুখোমুখি। উত্তরাধুনিক একজন কবি জগতের সবকিছুকেই একটি টেক্সট আকারে দেখেন। তবে এই টেক্সটের কোনো বাস্তব আকার থাকে না। ঠিক তেমনি কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের কবিতা বিনির্মাণমূলক একটি দৃষ্টিভঙ্গি বাছাই করে লেখা যা অত্যন্ত দূরদর্শী; এবং দারুণ ব্যতিক্রম। তাঁর কবিতাগুলোতে সেঁটে থাকে চমৎকারিত্ব এবং বিশেষ ব্যঞ্জনা। তাঁর কবিতা শুরু হয় হুটহাট, এর কোনো পূর্বনির্ধারিত অবয়ব থাকে না। তবে তা গভীর কোনো কিছু বলতে চায়,
‘‘গুমোট মেঘের মতো চেনা ছদ্মবেশে
বিজনে বাড়ন্ত এই তেজপাতা গাছে
মৃত্যু বিঁধে আছে— নীল। তাকে দেখেছিলে
আরব্য রজনী খুঁড়ে। দর্পণ কাঁপিয়ে
এসেছে সে নিরিবিলি: ‘এক গ্লাস পানি
এ যুদ্ধে সমরপতি’— বিষণ্ন কথাটি
বলেই মন্থর পায়ে চলে গেছে একা,
মরু-তরবারি নিয়ে আবার ফিরেছে।
তুমি তাকে বেশ চেনো। যে বোন মরেছে
তোমার চোখের পাশে, সেখানে দাঁড়িয়ে
কামরাঙা খেয়েছিল ওই উজবুক।
কেঁদেছ সেদিন খুব? নাকি অশ্রুক্লান্ত
ঘুমোয় নি বহুকাল। তোমাদের ঘরে
জগৎ-সংসার আজ কী লেখে বিকেলে?’’
কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ তাঁর কবিতায় প্রচলিত কাব্যভাষার ব্যবহার করেননি। খুব লক্ষ করলে বোঝা যায়, তিনি যেসব উপমা এবং চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন সেগুলোও বেশ চেনা। কিন্তু তাতে অচেনা গাম্ভীর্যের কোনো ঘাটতি নেই। তাঁর কবিতায় আঙ্গিকের রীতিসিদ্ধ বাধ্যবাধকতা থাকে না, থাকে অজস্র ছেঁড়া-ছেঁড়া চিত্রকল্প, যা সৃষ্টি করে এক অন্যরকম মায়াজাল।
‘‘একচক্ষু হরিণেরা বহুদূর গেছে
পরশ্রীকাতর তুমি রয়েছ সুগৃহে।
ছুটির মেজাজ নিয়ে কী কাজ কুটিরে?
উভচরে কিছুকাল আলস্যে কাটালে,
আরব্য আখ্যান ছুঁয়ে ঘোড়া ব্যবসায়ী
গিয়েছে তোমায় ফেলে ধু ধু মরুপথে—
দুয়োরানি হাসিমুখে সেখানে প্রণয়ী!
তার মধ্যে তাঁবু পাতো মাতম জাগিয়ে।’’
কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ এভাবেই বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তেজনার চাষ করেছেন। লিখেছেন পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা লেখা, যা বারবার পড়ার মত। পড়তে পড়তে আবার মনে আসে, তাঁর কবিতার গন্তব্য কোথায়? পাঠক বুঝতে পারে, তা স্পষ্ট নয়; আর নয় বলেই তা পাঠককে বেশি টানে। এভাবেই সার্থক হয়ে ওঠে উত্তরাধুনিক কবিতা হিসেবে। তবে যা বলতেই হয়, তা হল, ‘আলাদিনের গ্রামে’র কবিতাগুলো সংশয়ের কিংবা ক্লান্তির নয়। এই বইয়ের প্রায় সবগুলো কবিতাই সন্ধানের। এ জাতীয় কবিতাপাঠে বিস্ময়ের জাগরণ ঘটে। পাঠক তন্ময় হয়ে পড়তে থাকে,
‘‘ভাষাহীন গ্রামে তুমি অন্ধ আলাদিন
আগেই তৃষিত ছিলে, তিষ্ঠ তারপর
বক্ষজুড়ে ছাতি ফাটে— পানির চিৎকার,
জলে কোনো নদী নেই, তীরে বিঁধে আছো!
তোমার ভেতরে একা বসে নমরুদ
জ্বেলে দেয় অষ্টধাতু, মোমের রমণী;
আটঘাট বেঁধে সেই আলোপথ ধরে
এখনো অনেক ক্রোশ…চলো গেঁয়োভূত…
ফিরে এসো খেলাচ্ছলে আপন আড়ালে
পিপাসা তোমার মধ্যে দুই চক্ষু মেলে
আমার কাহিনিকার— লেখে পানিফল।
ওই ফল খেতে গিয়ে সহসা আবার
মিতালি-দোসর তুমি এসো আলাদিন,
এই দেহ ফুলগাছ, কাঁটা হয়ে বসো।’’
কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ যা বলতে চান তার সারমর্ম যেন এই, কিছুই গ্রহণ করা যাবে না, আবার অগ্রাহ্য করার মতও জগতে কিছু নেই। তাঁর কবিতা অর্থময়তার চেয়ে শব্দের ব্যঞ্জনা ও শক্তিকে গুরুত্ব দেয় বেশি। আর তা পাঠে আমার দারুণ এবং দুর্দান্ত মন ভাবনায় পড়ে যায়, প্রতিবারই-
‘‘তোমাকে বুঝতে হবে মঞ্জরিত সব
কথার ভেতরে আছে বোবা নীরবতা;
আড়ে-ঠারে আছে গাঢ় অনর্থের বন,
সেই বনে কাঠ কাটে অচেনা কাঠুরে—
দিনশেষে কাঠ নিয়ে গ্রামে পৌঁছে যায়;
তুমি পথে বাক্যহীন ফোয়ারা ছোটাও’’
‘আলাদিনের গ্রামে’র কবিতাগুলোর অন্তরসুরের ভাষা বেশ সহজ, প্রকাশভঙ্গিতে বিশেষ একটা ঝনঝন শব্দ যেন ঘিরে থাকে। আর এসবই পাঠককে মোহগ্রস্থ করে রাখে। প্রায় প্রতিটি কবিতায় পাওয়া যায় বহুরৈখিকতার টান। কবি যা লিখেছেন, তাতে আছে ব্যাখা ও যুক্তির অতীত সৌন্দর্য, যা আমাদের আন্দোলিত করে। সেসব পাঠে আরাম অনুভূত হয়, বুজে আসে চোখ!
‘‘ডাকিনি ঘুমালে ছোঁব রাতের কলিজা
শেহেরজাদির তন্দ্রা আলগোছে ধোব,
মুছে দেব কায়াবর্ম—আধুলি দেবে না?
ভিক্ষায় দাঁড়াব নুলো। বুভুক্ষের বেশে
আমার কাজই তো এই—চেরাগবিহীন
দৈত্যের ছায়ায় খল-তামাশা বানানো!’’
কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের কবিতা কেবল নিছক কয়েকটা শব্দ কিংবা পঙক্তি নয়, এগুলো কখনো কখনো কালের সারমর্ম হয়ে সামনে আসে,
‘‘দেহে আরো গিরিখাদ। গভীর পর্বতে
ভেতরে হারালে পথ, ও ভাস্কো দা গামা,
পর্তুগিজ এসেছিল। ম্যাপ হাতে তারা
দূরের মোকাম খোঁজে— সেই দেশ কোথা!
তোমামধ্যে সৌরবর্ষ। হেথা ঘোরে দীন,
আড়ালে ফুটিল দেহ…তরি ভেসে যা’’
কিছুদিন আগে ‘আলাদিনের গ্রামে’ বইটি নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। ঢাকার বাইরে থাকায় আমি সেদিন অংশ নিতে পারিনি। তবে পত্রিকা পড়ে জেনেছি, সেই আলোচনার শেষ অংশে বইটি নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেন কবি আলতাফ শাহনেওয়াজ। তিনি সেদিন বলেন, ‘‘কবিতা জীবনেরই অংশ। ২০১২ বা ২০১৩ সালের দিকে এটি লেখা। জীবনের বিমূর্ত সময়ে এই বইয়ের কবিতাগুলো আসে। আমার শুধু একটা জিনিসই মনে হচ্ছিল- এই নগর, এই শহর মানুষের যেটা কেড়ে নেয়, সেটা হচ্ছে তার মুখের ভাষা। আর এই জায়গাটি থেকে আমি আলাদিনকে দেখতে চেয়েছি।’’ আসলে একজন কবি যখন তাঁর সর্বময় অন্তর্নিহিত চাওয়াকে কয়েকটি লাইন লিখে বুঝাতে সক্ষম হন, তখনই তা হয়ে ওঠে সার্থক শিল্প, আমরা যাকে আদর করে কবিতা নামে ডাকি। ‘আলাদিনের গ্রামে’র লেখাগুলো সার্থক কবিতা, যা পাঠে পাঠকের মনে আসে বাঁধভাঙা জোয়ার।
দৈনিক ইত্তেফাক
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২