হাসান হামিদ
আমাদের এই দেশ নদীমাতৃক, সবার জানা এই কথা। কিন্তু এখানকার মানুষগুলো এখন কতটা নদী-প্রেমী? কবি নিমলেন্দু গুণের একটি কবিতা ‘কংশের সাথে সমুদ্রের বেশ মিল আছে’। এই কবিতায় কবি কংশ নদীকে সমুদ্রের সাথে তুলনা করেছেন। লেখার শুরুতেই কবিতাটির কয়েকটি লাইন পড়তে চাই-
‘একবার এসেই দেখুন, কংশ নদের সাথে সমুদ্রের বেশ মিল আছে।
একবার এসেই দেখুন, কংশ স্রেফ প্রথাসিদ্ধ শান্ত নদী নয়,
এখানে গর্জন আছে, শোঁ-শোঁ শব্দে হাওয়া ছোটে রাতে,
ঢেউ এসে সজোরে আছড়ে পড়ে তীরের নৌকায়’।
খুব ছোটবেলায় নদীর সাথে আমার সম্পর্কটি ছিল কেবলই শারীরিক। সময়-অসময় নেই, যে কোনো সময় ঝাঁপিয়ে পড়তাম নদীর বুকে। এরপর বয়স যত বেড়েছে, আমি টের পেয়েছি, এর সাথে সম্পর্কটি অনেকখানিই মানসিক হয়ে উঠেছে। নদীকে আমরা ছেলেবেলায় বলতাম গাং, গাঙ বা গাঙ্গ। আসলে গাঙ্গ শব্দটি এসেছে গঙ্গা থেকে। এ অর্থে গঙ্গাও নদীর নামবাচক শব্দ। আমার জন্ম যে গ্রামে, সেই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে এক নদী। সুমেশ্বরী নদী। একটি ছোট্ট নাম। অথচ কতো গভীর, কতো প্রশস্ত ব্যঞ্জনায় সে ছড়িয়ে আছে আমার জীবনে। আমার গ্রামের এই নদীর মতো এমনই কতশত নদী এদেশের মানুষের সঙ্গে সখ্যতার চাদরে জড়ানো, সেই হিসাব করা কি সহজ? কবি রফিক আজাদ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমার শৈশবের সুমেশ্বরীর মতোই অন্য এক সোমেশ্বরী নদীকে বর্ণনা করেছেন। সেখানে দেবতা শ্রেষ্ঠ তাতারারাবুগার কথা ওঠে এসেছে। সোমেশ্বরী নদীর সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনের কথাই যেন উঠে এসেছে-
‘সোমেশ্বরী নামে এক নদী
সম্পর্কিত খবর
মানুষেরা ভুলে গিয়ে প্রিয় দেবতারে
ভুলে বসতিটি গড়ে করে ভুলে-ভরা তুচ্ছ জীবনযাপন!’
সম্প্রতি বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের করা এক জরিপের প্রতিবেদন দেখে আমার মনে হলো, আমরা আর কবে নদী নিয়ে আরও সচেতন হব? সেই জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৪৭ বছরে প্রায় অর্ধেক নদী শুকিয়ে মরে গেছে। আর সরকারি তথ্যমতে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০৫ এ। অবশ্য বেসরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ২৩০। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ভাবনা আসাই তো স্বাভাবিক, আমরা কি অদূর আগামীতে আমাদের নদীগুলো হারাতে যাচ্ছি? এ ভাবনায় মন বিষাদ হয়। ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’ পড়ে, আর আশেপাশে এমন নদী দেখে, এর পাড় ধরে হেঁটেই তো আমরা বড় হয়েছি। আর মুখস্থ করেছি সেই লাইন, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। আমরা দেশকে মা বলি, আর এ দেশের মা কিন্তু নদী। নদীমাতৃক বাংলাদেশ বলতে আমাদের এই দেশে নদীর যে ভূমিকা, যে ব্যাপকতা বোঝায়; সেই অর্থে প্রশ্ন জাগে, নদী বলতে আমরা আসলে কী বুঝি? বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান পরিমার্জিত সংস্করণে নদী প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে- নদ (নদ) নদী শব্দের পুংলিঙ্গ; কপোতাক্ষ, বলেশ্বর, দামোদর, সিন্ধু, প্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদ নামে অভিহিত। নদ-নদী প্রসঙ্গে আভিধানিক ব্যাখ্যা দীর্ঘায়িত না করে বরং নদীবিষয়ক গবেষক মাহমুদ শামসুল হকের বক্তব্য তুলে ধরছি; নদী গবেষক মাহমুদ শামসুল হক তার নদী গ্রন্থে লিখেছেন-‘‘সাধারণ অর্থে যে জলপ্রবাহ নাদ বা কলধ্বনি করে প্রবাহিত হয় ‘তাই নদী’ বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা অনুসারে পণ্ডিতরা পুরুষবাচক নদ শব্দটির উদ্ভাবন করেছেন। দুয়ে মিলে নদ-নদী’’।
জানা কথা, পৃথিবীর আদি সভ্যতা ও মনুষ্য বসতি এই নদীকেন্দ্রিক। নদী তীরেই প্রাচীন সভ্যতাগুলো গড়ে ওঠেছিল। যেমন- ইরাকের ইউফ্রেতিস-তাইগ্রিস নদের সুমেরীয় সভ্যতা, সিন্ধুনদের মোয়েনজদারো ও হরপ্পা সভ্যতা, চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসি নদী সভ্যতা এবং মিশরীয়দের নীল নদের সভ্যতা। এর কারণ হিসেবে দেখা গেছে যে, প্রাচীন মানুষ প্রধানত যাতায়াতের সুবিধার্থেই নদীর তীরে বসতি গড়ে তুলেছিল। নদীর সুপেয় পানি এবং চাষাবাদের জন্য পানি- এ দুটো কারণ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখি, যেকোনো নদীর গঠনরূপ, পর্যায়, প্রকৃতি ও ক্রিয়াকাণ্ড নিয়তই বিবর্তনশীল। তাছাড়া নদ-নদীর এই নিরন্তর ছুটে চলার সঙ্গে মানুষ নিবিড়ভাবে একাত্ম হয়ে আছে প্রাচীনকাল থেকেই। এদেশের বেশির ভাগ নদ-নদীর জন্ম পাহাড়ে। তবে জন্ম যেখানেই না কেন, এসব নদীর উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। ভাবলে অবাক লাগে, নদীমাতৃক দেশ বলে বলে আমরাই এদেশের নদীওগুলোকে ভরাট করে, ধূষিত করে বিলুপ্ত করছি। অথচ অল্প কিছুকাল আগেও আমাদের এই বাংলাদেশে চার হাজার নদ-নদী বয়ে যেত। বর্তমানে এই নদীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আমাদের কারণেই বহু নদীর অবস্থান এখন বিলুপ্তপ্রায়।
গবেষকদের মতে, প্রতি বছর গড়ে ১০টি নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। ইতোমধ্যে দখল ও দূষণের কারণে বিলীন হয়ে গেছে ২৫টি নদী। বর্তমানে বিপন্ন নদীর সংখ্যা ১৭৪টি। সহজেই বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নদীমাতৃকতা বিশেষণটি হারিয়ে যেতে বসেছে মূলত নদী দখলের ফলে। নদীগুলো দখল হচ্ছে দুইভাবে, ভূমিদস্যুদের প্রকোপে নদী ভরাট করে স্থাপনা তৈরি এবং বর্জ্য ও শিল্প বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে নদীতে ফেলে। আমাদের দেশের প্রায় সব এলাকায় নদী, খাল-বিল এসব অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়ার কারণে পানিপ্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে নদ-নদী সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। ফলে বর্ষাকালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে গ্রামীণ এলাকায় অনেক স্থানে বৃষ্টির পানি জমে ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে যায়। ঠিক একই কারণে শহরাঞ্চলের ড্রেনেজ ব্যবস্থা সঠিকভাবে কাজ করছে না। বৃষ্টি ও অতি বৃষ্টিতে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে।
এ দেশের প্রাকৃতিক সব জলাশয় যেমন নদ-নদী, খাল-বিল এসবই আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। তাই এই জলাশয়গুলো সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নদী দখলদার ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে যত দেরি হবে, আমাদের ক্ষতির পরিমাণ ততো বাড়বে। পত্রিকায় পড়লাম, ঢাকাসহ বাংলাদেশের নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে আদালত থেকে বার বার নির্দেশনা এসেছে। সরকারও প্রায়শই নদীর ওপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার নদীগুলো দখল হচ্ছে। আর নদী দখলের ফলে রাজধানী ঢাকা সবচেয়ে বেশি হুমকিতে আছে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ নদীগুলো ক্রমাগত সংকীর্ণ হয়ে প্রবাহমানতা হারাচ্ছে। অপরদিকে শিল্প বর্জ্যে পানি দূষিত হয়ে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নানা প্রকারের বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। আশপাশের লোকজন এই দূষিত পানি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করলেও নদীর এই দূষণ এক জায়গায় স্থির থাকে না; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই দূষণ আমাদের খাদ্যচক্রেও প্রবেশ করছে। সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য তা কী ধরনের হুমকি সৃষ্টি করবে সেটি সহজেই অনুমেয়।
ভাবলে খারাপ লাগে, আমাদের নদীগুলো দখল করে প্রভাবশালীরা বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করছেন, অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছেন অবৈধভাবে। তাতে দেশ প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে নদী ও খাল। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, ভুল নদী শাসন আর দখল ও দূষণের কারণে এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে রয়েছে দেশের বেশিরভাগ নদী কিংবা খাল। মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি উষ্ণ মরুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ? কর্তৃপক্ষ কি যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ নিবেন?
লেখাটি শুরু করেছিলাম কবিতা দিয়ে, শেষ করছি কবি মহাদেব সাহার ‘এই যে বর্ষার নদী’ কবিতার কয়েক লাইন পাঠ করে,
‘দ্যাখো এই বর্ষাকাল, গাঁ-গেরামে ফুঁসে ওঠে নদী
হাঁসেরা নেমেছে জলে আমাকে বিভোর করো যদি,
কীর্তনখোলার বুকে উঠিয়াছে পূর্ণিমার চাঁদ
সেখানে পরানসখা- তুমি আমি দুজনে বিবাদ’।
প্রকাশিত পত্রিকা- দৈনিক সমকাল, ২৫ আগস্ট, ২০২১