ইতিহাস বলে, প্রাচীন গ্রিসে যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া আত্মহত্যা করত তাহলে তাকে সাধারণভাবে কবরস্থ করতে দেওয়া হত না। তখন ওই ব্যক্তির মৃতদেহ তার আপনজনরা সমাহিত করত শহরের বাইরে অবস্থিত অন্য কোনো জায়গায়। পাশাপাশি তার জন্য কোনো স্মৃতিফলকও ব্যবহার করা যেত না। তবে ইউরোপে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মহত্যাকে একটি পাপ হিসেবে গণ্য করে একে ‘শয়তানের কাজ’ বলে নিন্দা করা হয় ৪৫২ সালে। অবশ্য বিশেষ কোনো আইন বা নিয়ম তখনও করা হয়নি। এর অনেক পরে ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই আত্নহত্যা বিষয়ে একটি ফৌজদারি অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন। সেটি অত্যন্ত খারাপ ছিল। কেননা সেই আদেশ অনুযায়ী, যে ব্যক্তি আত্নহত্যা করত তার শরীরটি রাস্তায় টেনে এনে মাথা নিচু করে তাকে আবৃত করা হত আবর্জনা দিয়ে। শুধু তাই নয়, ওই লোকের সমস্ত সম্পত্তি জব্দ করা হত। এইসব করা হত, যাতে লোকে বুঝতে পারে আত্নহত্যা একটি খারাপ কাজ এবং এটি আর কেউ না করে। পরবর্তীতে রেনেসাঁর সময় থেকে আত্মহত্যার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে পরিবর্তন শুরু হয়। আর ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে ইউরোপে আত্মহত্যার ঘটনা পাপ থেকে উন্মাদনার কারণে সৃষ্ট ঘটনায় স্থানান্তরিত হয় বলা যায়। যদিও এই সময়ের মধ্যে আত্মহত্যা বেআইনিই ছিল। পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে আত্মহত্যা বৈধ বলে বিবেচিত হতে থাকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে।
এককালে মানুষ আত্মহত্যা করত অন্যের জীবন রক্ষার জন্য, কখনো শোকের কারণে, কেউবা ধর্ষণের জন্য লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে। কেউ কেউ নিজের জীবনকে নিজেই শেষ করার এই ঘৃণ্য কাজ করত সামরিক পরাজয়ের মতো অসহিষ্ণু পরিস্থিতি থেকে অব্যাহতি পেতে কিংবা শারীরিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের জন্য। কথা হলো, এখনকার সময়ে আত্মহত্যার কারণ কি একই? সভ্যতায় আমরা অনেক এগিয়েছি। শিল্পবিপ্লবের চতুর্থ পর্যায়ের দ্বারপ্রান্তে এসে আমাদের জীবনধারা ও বোধ একেবারেই আগের মতো নেই। কিন্তু আত্নহত্যা কখনো থামেনি; বরং আজকাল আরও বাড়ছে বলে পত্রিকায় নিয়মিত খবর পাই।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ফেসবুক লাইভে নিজের মাথায় পিস্তল তাক করে এক ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পুলিশ গণমাধ্যমকে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, দীর্ঘ দিনের একাকী জীবন, ক্যান্সারের সাথে লড়াই, ব্যবসায় লোকসান, এই সব কিছু থেকে চরম অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন আটান্ন বছর বয়সী ওই ব্যবসায়ী। সেটিই তার আত্মহননের পথ বেছে নেবার কারণ হতে পারে। শুধু এই ঘটনা নয়, ইদানীং প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকায় আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। অথচ সব অপমৃত্যুর খবর যে সংবাদমাধ্যমে আসে তা কিন্তু নয়। তবুও যা আসছে তা-ই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন আজকাল প্রায়ই শিক্ষার্থীদের আত্নহত্যার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেবল ২০২১ সালেই ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ভাবা যায়?
আঁচল-এর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্রীদের চেয়ে ছাত্রদের মধ্যে বেশি। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আত্মহত্যা করা ১০১ জনের মধ্যে ৬২ জন অর্থাৎ ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই সময়ে মেডিকেল কলেজ ও অনার্স কলেজের ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। আর এই সংখ্যাটি মোট আত্মহত্যাকারীর ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩। আঁচল ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। দেখা গেছে, ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এই বয়সসীমার ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে ১৮ থেকে ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ২৭ জন। এই পরিসংখ্যানটি তারা করেছে দেশের প্রায় ৫০টি জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার আত্মহত্যার সংবাদ বিশ্লেষণ করে।
আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, করোনাকালে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি এই এক বছরে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ। পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, হতাশা, আর্থিক সংকট এসবই আত্মহত্যার ঘটনার মূল কারণ। পত্রিকার খবর, হাসপাতাল ও থানা থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে উল্লেখিত পরিসংখ্যান করেছিল আঁচল ফাউন্ডেশন। পর্যবেক্ষণের জন্য তারা বেছে নেয় ৩২২টি আত্মহত্যার ঘটনাকে। তাদের রিপোর্ট বলছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে। তারা তুলনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গত বছরের এই সংক্রান্ত নিহতের সংখ্যার সঙ্গে। সংগঠনটির হিসাবে, এক বছরে আত্মহত্যা করার সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ।
অনেকে ভাবছেন, এইসব আত্নহত্যার সাথে করোনা মহামারির যোগসূত্র আছে। ধারণাটি একেবারে অমূলক নয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সম্প্রতি ভারতে মেডিক্যাল কাউন্সিল প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, করোনাকালে সব মিলিয়ে প্রায় ৪৩ শতাংশ ভারতীয় কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। লকডাউনের সময় এর পরিমাণ ছিল সবচেয়ে বেশি। লকডাউনের পর শতাংশের হার কমলেও জটিল মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। আর আমাদের দেশে পত্রিকার সংবাদ খেয়াল করলেই বোঝা যায়, করোনাকালে সারা দেশেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সময়ে আর্থিক টানাপোড়েন, লেখাপড়া ও পরীক্ষা নিয়ে হতাশা, পারিবারিক সহিংসতা, অভিমান এসব কারণে আত্মহত্যার ঘটনাগুলো ঘটেছে। করোনাকালে সাম্প্রতিক সময়ে নানা মানসিক চাপে আছে মানুষ। কেউ পরিবারের সদস্য বা বন্ধুকে অকালে চলে যেতে দেখেছে, হারিয়েছে চাকরি, নানা কারণে তৈরি হয়েছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। এসবই আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। যৌন নিপীড়নের শিকার, অবহেলা, কিংবা অতি দারিদ্র্য আত্মহত্যার ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত বলা যায়। আর এগুলো করোনাকালে অনেকখানি বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন প্রায় দশ লক্ষ মানুষ। তাদের মতে, সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আত্নহত্যার হার বেড়েছে। এই বৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে দেখা যায়। আর আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় সংখ্যক দেশ চীন এবং ভারত, মোট অর্ধেকেরও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। নারীদের তুলনায় পুরুষদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। একই ভাবে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই প্রতিবেদনের তথ্য আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থার মতই বলা যায়। শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা আঁচল ফাউন্ডেশনের রিপোর্টে আত্মহত্যাকারীদের বয়স, প্রবণতার লিঙ্গ এসব মিলে যায় উল্লেখিত প্রতিবেদনের সাথে।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে, আত্মহত্যার সাথে মানসিক অসুখের বেশিরভাগ সময়ই একটা সম্পর্ক থাকে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দূরাবস্থা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায় এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। একজন মানুষ তখনই আত্নহত্যার মতো ঘটনা ঘটায় যখন সে কোনো কারণে হতাশ হয়, ব্যর্থ হয় কিংবা জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলে। এসবের ফলে তার মধ্যে কাজ করে বিষণ্ণতা আর উদ্বিগ্নতা। কখনো কখনো জীবনের কোনো পর্যায়ে এসে কেউ মনে করে সে আর সফল হতে পারবে না এমনকি সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা আর তার নেই। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্যদের বোঝা হওয়ার অনুভূতি জন্মে অনেক সময়। একজন তরুণ শিক্ষার্থী যে স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠে তা যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন সে হতাশ হয়। সে মনে করতে থাকে, তাকে দিয়ে কিছু হবে না বা সমাজে সে ছোট মনে করতে থাকে নিজেকে। তখন সে আর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এভাবেই সে আত্নহত্যা প্রবণ হয়ে উঠে।
তরুণদের আত্নহত্যা প্রবণতা বাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখন অনলাইনভিত্তিক মিডিয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেটভিত্তিক নানা ভিডিও বা ব্লগে আত্মহত্যার বিবরণটির সাথে এই কাজটির বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করায় কেউ কেউ। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুনরাবৃত্তিমূলক কভারেজের কারণে। এভাবে কখনো কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টিকে যৌক্তিক বলে আত্মহত্যার প্রশংসা বা রোমান্টিসাইজ করা হয়। আবার সংবাদ মাধ্যমে বা ভিডিওতে যখন একটি নির্দিষ্ট উপায়ে কী করে নিজেকে হত্যা করা যায় তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়, তখন এটির প্রবণতা বাড়তে পারে। এইসব ঝুঁকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেশি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার শুরুর সময় থেকে আমাদের দেশে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস অনিয়মিত হয়ে যায়। তাছাড়া লকডাউনে দীর্ঘ সময় ঘরে বসে থাকা, সেশনজটে পড়ে পিছিয়ে যাওয়া, চাকরি পাওয়ার অনিশ্চয়তা, পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা তৈরি হওয়া এইসব কারণে বিষণ্ণতা তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আর এই বিষণ্ণতাই অনেককে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে। পাশাপাশি বন্ধু, আত্মীয়, পরিবারের সদস্যদের অবিবেচকের মত ব্যবহার, বাবা-মায়ের প্রত্যাশা মেটাতে না পারার হতাশা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের নানা অর্জনের খবরের সাথে নিজেদের তুলনা করার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার হার বাড়ছে বলা যায়। আর এসবই আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলছে কাউকে কাউকে। অথচ আমরা জানি, আত্মহত্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আসলে প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।
দৈনিক ইত্তেফাক
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২