অঙ্গারে মৃত্যু আর কত?

হাসান হামিদ

কাগজ পড়ার সময় একটি খবরে চোখ আটকে গেলো। না, পোড়ে মারা যাওয়ার এ খবর নতুন নয়। এদেশে প্রায় প্রতিদিন ঘটছে এমন ঘটনা। আমাদের আর মনেই হয় না, একটি মানুষের মৃত্যু মানে শুধু তার চলে যাওয়া নয়; পাশাপাশি একটি পরিবারের সারা জীবনের হাহাকার রচনা হওয়া। অথচ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাটের গুদাম পুড়েছিল বলে বঙ্গবন্ধু নিজে দৌলতপুরে গিয়ে পোড়া পাট ধরে কেঁদেছিলেন। কিন্তু এখন এতো যে মানুষ মারা যায়, কে রাখে তাদের খবর?

সর্বশেষ গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় ন্যাশনাল ফ্যান কারখানায় গত মঙ্গলবার (০২ অক্টোবর, ২০১৮) দুপুরে বিস্ফোরণে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এতে ঘটনাস্থলেই দুইজন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। জানা যায়, কারখানার শ্রমিকেরা কাজ করছিলেন। এমন সময় ভেতরে হিট চেম্বারে বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ধরে যায়। আর এতে ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হয়ে দুই শ্রমিক নিহত হন। এছাড়া গুরুতর দগ্ধ কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। এদের থেকেও হয়তো আরও কেউ চলে গিয়ে বাড়াবে লাশের মিছিল। হতাশার কথা হলো, অন্য সব ঘটনার মতোই, গাজীপুরের এ ঘটনার পর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবারই এ ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে কিংবা দুর্ঘটনা তদন্তে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এবারও হয়তো এক সপ্তাহ পর প্রতিবেদন দিবে। তারপর সব থেমে যাবে। কোনরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই অর্থাৎ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ছাড়া সবাই পার পেয়ে যাবে। অতীতের সকল রেকর্ড কিন্তু এ কথাই প্রমাণ করে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে?

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে সারা দেশে আঠারো হাজারেরও বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং এতে  কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত হয়েছেন। আর এসব অগ্নিকাণ্ডে দেশের ক্ষতি হয়েছে  ৪৩০ কোটি টাকার মতো, যা উদ্বেগজনক। পত্রিকা পড়ে জানলাম, এসবের বেশির ভাগই ঘটেছে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, চুলার আগুন, ছুঁড়ে দেওয়া জ্বলন্ত সিগারেট ইত্যাদি থেকে। কলকারখানায় অগ্নিকান্ড ঘটেছে এক হাজারের মতো, আর দোকান-পাটে প্রায় দুই হাজার। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু হওয়ার পর গত দুই দশকে ৭০০ গার্মেন্টস শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের মনে আছে, ছয় বছর আগে তাজরীন ফ্যাশনে লাগা আগুনে ১১১ জন শ্রমিকের পুড়ে মারা যান। গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হন আরও অনেক শ্রমিক। বাঁচার আশায় ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে পঙ্গু হয়ে যান কেউ কেউ। এরপর কারখানায় নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিস্তর কথা-বার্তা হলেও, থেমে নেই কারখানা দুর্ঘটনার খবর।

আমাদের দেশে বহুবার অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় সবারই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এতবড় বড় প্রতিষ্ঠানে যেখানে হাজার হাজার কর্মী কর্মরত, সেখানে কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে না? কেন থাকে না জরুরি বহির্গমন ব্যবস্থা? কোনো আইন নেই? আসলে আমাদের জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিদের অনেকেই গার্মেন্টস মালিক, ফলে শ্রমিকদের কল্যাণে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও আইন বাস্তবায়ন খুবই দুরূহ।

এবার দেখি আমাদের দেশের শ্রম আইন কী বলে! বাংলাদেশের শ্রম আইন-২০০৬ এর ৬২ ধারায় অগ্নিকান্ড সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা আছে। উপধারা (১)-এ প্রত্যেক তলার সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী বিকল্প সিঁড়িসহ বহির্গমনের উপায়, উপধারা (৩)-এ বহির্গমনের পথ তালাবদ্ধ বা আটকে রাখা যাবে না, উপধারা (৪)-এ বহির্গমনের জন্য ব্যবহারযোগ্য পথ, দরজা-জানালা লাল রং দ্বারা চিহ্নিতকরণ, উপধারা (৫)-এ স্পষ্টভাবে শ্রবণযোগ্য হুঁশিয়ারী সংকেতের ব্যবস্থা, উপধারা (৬)-এ প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কক্ষ থেকে অগ্নিকান্ডের সময় বহির্গমন পথে পৌঁছানোর অবাধ ব্যবস্থা, উপধারা (৮)-এ প্রতি বছর অন্তত একবার অগ্নি নির্বাপণ মহড়া আয়োজনের ব্যবস্থার কথা বলা আছে। কিন্তু শ্রম আইনের ৬২ ধারার এই উপধারাগুলো কোন গার্মেন্টস-এ মানা হয় কী-না তা বলা মুশকিল।

ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় কারখানা স্থাপনের  অনুপযুক্ত বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে উঠেছে গার্মেন্টস, শিল্প-কারখানা, মার্কেট, কাঁচা-বাজার। এসব কারখানায় ছোট ছোট কক্ষে বসানো হয়  ভারি যন্ত্রপাতি। আর অনেক কারখানায় আলাদা গুদাম না থাকায় ভবনের মধ্যেই বিভিন্ন তলায় মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। আএ এসবের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে দিনরাত কাজ  করে শিল্পশ্রমিকরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে থাকে না শ্রমিকদের ওঠানামার জন্য প্রশস্ত  সিঁড়ি ও জরুরি বহির্গমনের আলাদা কোনো পথ। এমনকি অনেক গার্মেন্টস বা শিল্প-কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকে না। আবার থাকলেও প্রয়োজনের সময়  কারখানা শ্রমিকদের অজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণের অভাবে তা ব্যবহৃত হয় না। এদেশে বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটকে দায়ী করা হয়ে থাকে। আসলে এদেশে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তার, ফিটিংস, ফিউজ, সার্কিট ব্রেকার সঠিক মানসম্পন্ন নয়। নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেও রয়েছে শৈথিল্য। এসব কারণে দিন দিন বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের  ঝুঁকি।

আমরা একবারও ভাবি না, ক্রমাগত  অগ্নিকাণ্ডের ফলে  দেশের পোশাক শিল্প খাতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। পোশাকশিল্পে আগুনের কারণে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেজন্য বিদেশীরা এই খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবে স্বাভাবিক। আর এভাবে ক্রমশঃ পোশাক শিল্পের বাজার ছোট হয়ে আসবে। বেড়ে যাবে বেকারত্বের হার; আর সেইসাথে বৃদ্ধি পাবে অপরাধকর্ম। এভাবে অর্থনৈতিকভাবে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এখনো সময় আছে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেবার।

প্রকাশিত পত্রিকা-

দৈনিক দেশকাল ১৪/১০/২০১৮

শিক্ষাবার্তা ১৪/১০/২০১৮

অঙ্গারে মৃত্যু আর কত?
Scroll to top